ব্যাংক লুটেরা বাচ্চুর ভেলকি
বিশেষ প্রতিনিধি : বেসিক ব্যাংকের সেই বাচ্চু লুটেরারা কি পার পেয়ে যাচ্ছে! লুটেরা বাচ্চুর ভেলকিতে দুদক দিশা যেন পাচ্ছেনা। গত ছয় বছরেও উদ্ধার হয়নি লুটের টাকা কানাকড়িও। মামলা সত্ত্বেও চার্জশিট দাখিলে নির্দিষ্ট করে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারছে না দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ যেন আরেক ভেলকি! হাতিয়ে নেওয়া অর্থ উদ্ধারে অর্থঋণ আদালতে মামলা করেই সার সংশ্লিষ্ঠরা।
আদালতের বাইরে আপস-মীমাংসার ভিত্তিতে খেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায়েও কোনো অগ্রগতি নেই। এর আগে বেসিক ব্যাংক থেকে ২ হাজার ৩৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন ও গুলশান থানায় ১২০ জনকে আসামি করে ৫৬টি মামলা করে দুদক। মামলা দায়েরের পর ৬ বছরের বেশি সময় পার হলেও তদন্ত শেষ হয়নি এখনো। মামলাগুলোর তেমন কোনো অগ্রগতিও নেই।
অভিযোগ রয়েছে কারো প্রচ্ছন্ন হস্তক্ষেপে মামলাগুলো বেহাল অবস্থায় পরিণত হচ্ছে। মামলার তদন্ত দীর্ঘসূত্রতায় হাইকোর্ট থেকে পর্যবেক্ষণ এসেছে। সূত্র জানায়, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি নিয়ে দুদকে পাঠানো বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রতিবেদনেই অর্থের গতিপথ শনাক্তের অনেক উপাদান ছিল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কিন্তু ওসব গতিপথ চিহ্নিত না করেই মামলাগুলোর ইতি টানছে না দুদক। যেন ঝুলে রাখার একটা প্রক্রিয়া পেছন থেকে কেউ কলকাঠি নাড়ছে।
বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা উদ্ধার করে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে বলে গত বছর আদালতে দাখিল করা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল দুদক। কিন্তু উদ্ধার হওয়া এ অর্থ সত্যিই সরকারি কোষগারে জমা হয়েছে কিনা সেটি নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। কারণ উদ্ধার করা এ অর্থ কোথায় কীভাবে আছে সেটি সম্পর্কে জানে খোদ বেসিক ব্যাংকই। আবার এ অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও জানার কথা। কারণ সরকারের সব অ্যাকাউন্ট মেইনটেইন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ অর্থ আদৌ সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে কিনা সেটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও বলতে পারছেন না।
বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে ব্যাংকটির শান্তিনগর শাখা ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর জামিনসংক্রান্ত একটি মামলার লিখিত রায় প্রকাশিত হয়। এতে আদালত বলেন, কমিশন (দুদক) ফলো দ্য মানি অনুসরণ করে তদন্তের যে কার্যক্রম পরিচালনা করছে তাতে আদালতের বলতে কোনো সংকোচ নেই যে, কমিশন বর্তমান মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে ভুল পথ অনুসরণ করেছে এবং করছে।
এ বিষয়ে আদালতের সুচিন্তিত অভিমত হলো- উপরোক্ত অপরাধ প্রমাণে আত্মসাৎকৃত অর্থের গতিপথ শনাক্ত করা আদৌ কোনো অপরিহার্য বা বাধ্যতামূলক শর্ত হতে পারে না। কমিশনের দায়িত্ব দুর্নীতি চিহ্নিত করা এবং অপরাধীদের আইন ও বিচারের আওতায় নিয়ে আসা।এ সম্পর্কে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, আদালতের এ ক্ষোভ প্রকাশটা খুবই বাঞ্ছনীয় ও যৌক্তিক। কারণ এত বছরেও একটি মামলার চার্জসিট দিতে পারেনি দুদক। দাবি করা হয়, কারও সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায় না।
তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু থাকাকালে এবং তিনি চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউ থেকে পরিদর্শনগুলো করা হয়েছে। সেখানেই বলা আছে, এ ধরনের নজিরবিহীন ঘটনায় কার কি সংশ্লিষ্টতা ছিল। তাই হাতিয়ে নেওয়া টাকা কোথা থেকে কোথায় মুভ করল তা আগেই শনাক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কার কি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, সেটা ধরে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া। এ ক্ষেত্রে সব দায়-দায়িত্ব কমিশনকে নিতে হবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক মো. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আদালতের রায়টা আমি পড়ে দেখেছি। এতে দেখা যায়, আদালত ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতি ও দুর্নীতি হয়েছে। এখন দুদকের উচিত আদালতের পর্যবেক্ষণকে গুরুত্ব দিয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির পথে এগোনো।
২০২১ সালের ২১ জানুয়ারি ওই শাখা ব্যবস্থাপক উচ্চ আদালতে জামিন আবেদন করেন। কিন্তু বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ৫৬ মামলার একটিতেও দুদক চার্জশিট দিতে না পারায় ওই জামিন আবেদনের শুনানিতেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন আদালত। একই সঙ্গে এক মাসের মধ্যে ৫৬ মামলার অগ্রগতি সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন আদালতে দাখিলের জন্য দুদককে নির্দেশ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী ওই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে দুদক। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ৩১০০ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে ফিরেছে। কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে এ অর্থ জমা দেওয়া হয়েছে।
এর আগে দুদক থেকে একাধিকবার বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির অর্ধেকের বেশি অর্থ উদ্ধারের দাবি করা হয়। এ বিষয়ে খোঁজ নিলে বেসিক ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো জানায়, দুদক থেকে যে অর্থ উদ্ধারের দাবি করা হচ্ছে, সেই অর্থের বিষয়ে ব্যাংকটির কাছে কোনো তথ্য নেই। জানতে চাইলে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল হাসেম বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। বিষয়টি নিয়ে তিনি ব্যাংকের এমডির সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
পরে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, আমি বিষয়টি শুনেছি। তবে এ অর্থের হদিস আমাদেরও জানা নেই। কারণ বেসিক ব্যাংকে এ ধরনের কোনো টাকাই জমা করা হয়নি। তিনি বলেন, নিয়মানুযায়ী এ টাকা বেসিক ব্যাংকের যেসব অ্যাকাউন্টের বিপরীতে বের করে নেওয়া হয়েছে, সেসব অ্যাকাউন্টেই জমা হওয়ার কথা। কারণ কোনো একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঋণ সৃষ্টি করে এ টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে। তাই এ টাকা বেসিক ব্যাংকের পরিবর্তে সরকারি কোষাগারে কেন জমা করা হবে। আর সরকারি কোষাগারে জমা হলেও তা বেসিক ব্যাংকের কাছেই আসার কথা। কিন্তু আমরা তো এ ধরনের কোনো টাকা ফেরত পাইনি।
এদিকে, সরকারি কোষাগারে অর্থ জমার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে খোঁজ নিয়েও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সরকাররের ব্যাংক হিসাবগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে বিভাগটি দেখভালের দায়িত্বে ওই বিভাগের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা অর্থ জমার বিষয়টি জাননে না বলে জানান।বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, বেসিক ব্যাংকের যে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে, সেটা তো অদাবিকৃত কোনো টাকা নয়। তাই এ টাকা উদ্ধার হলে তা সরকারি কোষাগারে জমা হলেও তা বেসিক ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে ক্রেডিট হতো। কিন্তু আমার জানামতে এ ধরনের টাকা জমা হয়েছে বলে শুনিনি।
দুদক আইনে প্রতিটি মামলার তদন্ত সর্বোচ্চ ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে শেষ করার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু বেসিক ব্যাংকের ৫৬ মামলার ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ের পরও অতিরিক্ত কয়েক বছর পেরিয়ে গেছে। তার পরও আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইউর তদন্তে উঠে আসে, জাল দলিলে ভুয়া ও ঠিকানাবিহীন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে বেশিরভাগ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ অধিকাংশ প্রতিবেদনে আবদুল হাইয়ের সংশ্লিষ্টতার কথা উঠে আসে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাম আবদুল মুহিত বেসিক ব্যাংকে ‘হরিলুটের পেছনে আবদুল হাই বাচ্চু জড়িত বলে উল্লেখ করেন। জাতীয় সংসদেও বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে আলোচনা হয়।কিন্তু কোনো মামলায়ই বাচ্চুকে আসামি করা হয়নি। আদালতের একটি আদেশের পর ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে তাকে প্রথমবারের মতো তলব করে ৫ দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। এর আগে আবদুল হাই বাচ্চুকে বাদ দিয়ে ২০১৫ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ১২০ জনকে আসামি করে ৫৬টি মামলা করে দুদক। মামলায় ২ হাজার ৩৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়।