বিশেষ প্রতিনিধি : নোয়াখালীর এমপি একরামুলের হুংকারের পর ”গাড়ীচাপা’য় শাবাব কেলেংকারি” ফের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে নোয়াখালীর সর্বত্র। সবাই বলাবলি করছেন এমন গুনধর পুত্রের কেলেংকারিতো মানুষ ভুলে যায়নি।
সেই পুত্রের জন্যে এমপি একরামুল সংবিধানও লংঘন করে চলেছেন।
গত ১৬ এপ্রিল মঙ্গলবার সুবর্ণচর উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নে একটি পথসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে নোয়াখালী-৪ (সদর ও সুবর্ণচর) আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী বলেছেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তাঁর ছেলেকে ভোট না দিলে উন্নয়ন বন্ধ করে দেওয়া হবে।
ভোট নিয়ে তিনি গিফ এন্ড টেক পলিসিও তুলে ধরেন। ওই পথসভায় একরামুল চৌধুরী আরও বলেন, যে এলাকা থেকে ভোট কম দেবেন, সে এলাকায় আমি কোনো উন্নয়নে হাত দিব না। নিজ নিজ এলাকা, গিভ অ্যান্ড টেক। আমাকে দিবেন, আমি আপনাদের দিব। আমারে এমপি বানাইছেন, আমি তো বলছি, পাঁচ বছর ক্ষমতায় আছি, এখন আমার মনমতো উপজেলা চেয়ারম্যান যদি বানান, আমার মিডলম্যান (মাঝের ব্যক্তি) আমি আপনাদের উপহার দিয়ে গেলাম।
জানা গেছে, সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন সংসদ সদস্য একরামুলের ছেলে আতাহার ইশরাক ওরফে শাবাব চৌধুরী। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও টানা তিনবারের উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এ এইচ এম খায়রুল আনম চৌধুরী। আগামী ৮ মে এখানে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ছেলের জন্যে নেতাকে বাদ দিয়ে তিনি সংবিধান লংঘন করে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এখানে একরামুল করিম কেবল ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হননি, তিনি একদিকে জনগণকে হুমকি দিয়েছেন, অন্যদিকে প্রলোভনের মুলা ঝুলিয়েছেন। যে এলাকার লোকজন তাঁর ছেলেকে ভোট দেবেন, সেই এলাকায় উন্নয়ন হবে, আর যে এলাকার মানুষ ভোট দেবেন না, সেই এলাকায় উন্নয়ন হবে না?
এ সম্পর্কে প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি সোহরাব হাসান এক প্রতিবেদনে বলেছেন, এমপি মহোদয় যদি এলাকাবাসীর জন্য তাঁর পুত্রকে উপহার দিয়ে থাকেন, তাহলে ভোটের দরকার কী। সংসদ সদস্য নিজের পুত্রকে বিনা ভোটে বিজয়ী ঘোষণা করে দিলেই পারেন। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে একরামুল করিম চৌধুরী সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। সংবিধানে সংসদ সদস্যের শপথনামায় আছে, ‘আমি…সংসদ সদস্যরূপে আমার কর্তব্যপালনকে ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হইতে দিব না।’
এখানে একরামুল করিম কেবল ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হননি, তিনি একদিকে জনগণকে হুমকি দিয়েছেন, অন্যদিকে প্রলোভনের মুলা ঝুলিয়েছেন। যে এলাকার লোকজন তাঁর ছেলেকে ভোট দেবেন, সেই এলাকায় উন্নয়ন হবে, আর যে এলাকার মানুষ ভোট দেবেন না, সেই এলাকায় উন্নয়ন হবে না, এটা কেমন কথা? এর মাধ্যমে এমপি মহোদয় জনগণকে জিম্মি করতে চাইছেন। কিন্তু তাঁর মনে রাখা উচিত, জনগণের করের অর্থে উন্নয়নকাজ হয়। এমনকি তাঁরা যে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন–ভাতা পেয়ে থাকেন, তারও জোগান দিয়ে থাকে জনগণ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২০ জুন এমপি একরাম চৌধুরীর ছেলে শাবাব রাজধানীর মহাখালী উড়ালসড়কে গাড়িচাপা দিয়ে এক ব্যক্তিকে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন। দায়ী গাড়িটিকে পুলিশ চিহ্নিত’ও করে পুলিশ। গাড়িটির নম্বর ঢাকা মেট্রো ১৩-৭৬৫৫।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটিতে (বিআরটিএ) খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাড়িটির মালিক কামরুন্নাহার শিউলি। তিনি নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর স্ত্রী ও নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার চেয়ারম্যান। তবে ওই দুর্ঘটনার পর গাড়িটি দ্রুত এসে সংসদ ভবনের উল্টো দিকের ন্যাম ফ্ল্যাটে যখন ঢোকে, তখন সেটিকে অনুসরণ করেন এক মোটরসাইকেল আরোহী ও আরেকজন প্রাইভেট কার আরোহী।
তাঁরা জানিয়েছেন, গাড়িটি ওই ভবনে ঢোকার পর একজন তরুণ গাড়ি থেকে নামেন। ভবনটির আনসার ও প্রহরীরা জানিয়েছেন, ওই তরুণের নাম শাবাব চৌধুরী। তিনি কামরুন্নাহার শিউলি ও সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর একমাত্র ছেলে। গাড়িটি তিনিই চালাচ্ছিলেন।
এ ঘটনা ছাড়াও ১৪ জুলাই ২০২০ সালে এই শাবাব আরেক কেলেংকারি করে বসেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শাবাব এবার পুলিশের গাড়িকে ধাক্কা দিয়েছে। এমপি–পুত্রের’ এহেন আচরণের পর খবরের শিরোনামে বলা হয়, গাড়িচাপায় হত্যার ঘটনা ছিল ঢাকার, আর পুলিশের গাড়িতে ধাক্কার ঘটনা চট্টগ্রামে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুই বছর আগে গাড়ি চালিয়ে এক ব্যক্তিকে হত্যার পরও শাস্তি হয়নি নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে শাবাব চৌধুরীর। এবার চট্টগ্রামে পুলিশের গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে আরও একবার আলোচনায় এলেন তিনি (এমপি–পুত্র)।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, এমন ‘গুণধর’ পুত্রকেই জনগণের প্রতিনিধি বানাতে মাঠে নেমেছেন একরামুল। জোর করেই ছেলেকে উপজেলা চেয়ারম্যান বানাতে চান তিনি। প্রশ্ন হলো, সংসদ সদস্য হলেই কি তিনি যা খুশি তা বলতে পারেন! দেশে আইনকানুন বলে কিছু নেই? এমপি একরামুল করিম তো সরকারি উপজেলা নির্বাচনকে (বাছাইপ্রক্রিয়া) চ্যালেঞ্জ করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি নির্বাচনী আচরণবিধিই লঙ্ঘন করেননি, নির্বাচন কমিশনকেও চ্যালেঞ্জ করেছেন। এখন দেখার বিষয়, নির্বাচন কমিশন তাঁর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়।
একরামুল করিম চৌধুরী যখন জনগণকে হুমকি দিয়ে নিজের ছেলেকে জিতিয়ে আনতে চাইছেন, তখন দলের মন্ত্রী–সংসদ সদস্যদের সন্তান, পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের উপজেলা ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।