ব্ল্যাকমানি সাদা হচ্ছে
শফিক রহমান : আসন্ন জাতীয় বাজেটে ফের ব্ল্যাকমানি বা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আসছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। এ সুযোগ নিতে পারবে যার কাছে কালো টাকা আছে তারাই। অন্যদিকে বাড়তি করের চাপে পিষ্ট হতে পারে মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী। স্বাধীনতার অর্ধশতাধিক বছরে এ পর্যন্ত মোট ২১ বার ব্ল্যাকমানি নানাভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে সুযোগটি মিলেছে ৪০ বছর। সাধারণত দেশের অভ্যন্তরে উপার্জিত কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেওয়া হয় দেশের বাইরে পাচার করা অর্থ দেশে আনার সুযোগ। জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত কালো টাকা সাদা হয়েছে মাত্র ৪৭ হাজার কোটি টাকা। সাধারণত সাদামাটা ঘোষণায় কালো টাকা সাদা করার বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু সুযোগ না নিলে কী শাস্তি দেওয়া হবে, তা বলা হয় না।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, ‘কেউ সুযোগ গ্রহণ না করলে সরকারের কিছু করার নেই। আমরা এ প্রস্তাবকে বিবেচনায় নিয়ে বাজেট তৈরি করিনি। আমরা বাজেটে এ সুযোগটি রেখেছি।’ অবশ্য তিনি ঠিকই বলেছেন। যেহেতু এ সম্পর্কিত কোনো আইন ও শাস্তির বিধান নেই, তাই কালো টাকা সাদা করার প্রতিও কারও আগ্রহ নেই।
বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও -বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি. এর পরিচালক ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, আবারও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আসছে বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হচ্ছে। স্বাধীনতার অর্ধশতাধিক বছরে এ পর্যন্ত মোট ২১ বার নানাভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
চলতি বছর জুড়েই নিয়মিত আলোচনায় চলছে দ্রব্যমূল্য বাড়ার খবর। ভুক্তভোগীরা বলছেন, বাজারের শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কাছে সরকারি নীতিনির্ধারকরা রহস্যজনক অসহায়ভাবে নিজেদের উপস্থাপন করছেন।ওদিকে করোনার প্রভাব, বিশ্বজনীন অস্থিরতা বা ডলার সংকটসহ ডলারের বাড়তি দাম অস্থিরতা সর্বত্র।
এসবের মাঝে বৃহস্পতিবার আসছে, ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকার নতুন বাজেটের ঘোষণা। যাতে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশে নীতিমালা গ্রহণ করলেই হয় না সে নীতির ব্যাখ্যা জনগণকে দেয়া লাগে। আস্থা না পেলে নাগরিকরা কর দিতে আগ্রহী হবেন না।বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে উচ্চবিত্তদের, আর বাড়তি করের চাপে আরও পিষ্ট হতে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি।
মূল্য সংকোচনের নীতি বলা হলেও, বাড়তি রাজস্ব আদায়ের তাড়ায় চাপা পড়ে যাচ্ছে তা। তথ্য বলছে, বাড়ছে না করমুক্ত আয়ের সীমা। আরও ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বসছে মোবাইল ফোনের খরচে। বাড়তি শুল্কের কারণে দাম বাড়বে সিগারেটের। ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে বিভিন্ন বিনোদন পার্কে প্রবেশের টিকিটও।
এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় নেয়া বড় বাজেট নষ্ট করবে আর্থিক শৃঙ্খলা।
বর্তমানে শূন্য শুল্ক দিয়ে আমদানি করা যায় চাল, গম, ভুট্টা, সরিষা বীজ, পরিশোধিত সয়াবিন তেল,ভিটামিন, ইনসুলিন, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন অত্যাবশ্যক ওষুধ ও তার কাঁচামাল। এ তালিকার সাড়ে তিনশর মধ্য থেকে একশটি পণ্যতে বসছে ১ শতাংশ শুল্ক হার। আবার, ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হচ্ছে ফ্রিজ ও রেফ্রিজারেটর উৎপাদনের শুল্ক। বাদ যাচ্ছে না বিভিন্ন ধরণের জুসও, যার উৎপাদনে শুল্ক গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ৫ থেকে ১৫ শতাংশে।
স্বাধীনতার অর্ধশতাধিক বছরে এ পর্যন্ত মোট ২১ বার নানাভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে সুযোগটি মিলেছে ৪০ বছর। সাধারণত দেশের অভ্যন্তরে উপার্জিত কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেওয়া হয় দেশের বাইরে পাচার করা অর্থ দেশে আনার সুযোগ। কিন্তু এখনো সুযোগটি কেউ নেননি।বারবার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে সমাজ একটি বার্তা দেয় যে, ‘তুমি দুর্নীতি করো, আমি বৈধ করে দেব।’ তাই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দুর্নীতিসহায়ক। বছরের পর বছর এ সুযোগ দিয়েও তেমন সাড়া পায়নি সরকার। অর্থাৎ কালো টাকা সাদা করার সুযোগগুলো কার্যত অকার্যকরই থেকে গেছে। আবার কালো টাকার মালিকদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশ কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে। তবে কোনো দেশই বাংলাদেশের মতো ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’র ব্যবস্থা করেনি। ওইসব দেশ কয়েকবার স্বল্প সময়ের জন্য সুযোগটি দিয়েছে। তাদের এ নাগরিকরাও সুযোগ লুফে নেন। কারণ, সুযোগ না নিলে শাস্তি প্রদানের হুমকিও দিয়ে রেখেছিল সেসব দেশ। অথচ বাংলাদেশে ঢালাওভাবে এবং প্রায় সবসময় সুযোগ দেওয়া হলেও এর সুফল মেলে না। কালো টাকার মালিকরা মনে করেন, এ সুযোগ ভবিষ্যতে আরও মিলবে, অথবা সাদা না করলেও কিছু আসে যায় না।
দেশে বিভিন্ন সরকারের আমলে ৫ থেকে ২০ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। এর বাইরে বাড়ি, ফ্ল্যাট ও জমি ক্রয় এবং শেয়ারবাজার ও শিল্প খাতে বিনিয়োগের বিপরীতেও এ সুযোগ মিলেছিল। নৈতিকতার সঙ্গে সমঝোতা করে কালো টাকার সুযোগ দেওয়া হয়। অথচ তেমন কর আদায় হয় না। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ সুযোগ দিয়ে সৎ করদাতাদের প্রতি অন্যায় করা হয়। জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত কালো টাকা সাদা হয়েছে মাত্র ৪৭ হাজার কোটি টাকা। সাধারণত সাদামাটা ঘোষণায় কালো টাকা সাদা করার বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু সুযোগ না নিলে কী শাস্তি দেওয়া হবে, তা বলা হয় না।
জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৬ সালে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা বলা হলেও তেমন সাড়া মেলেনি। এরপর ২০০৬-০৭ সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্স গঠন করেছিল। প্রকাশ করেছিল সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের তালিকা। ওই বছর প্রায় ৩২ হাজার করদাতা ১১ হাজার ১০৭ কোটি টাকা সাদা করেন। মূলত ভয়েই তখন প্রচুর মানুষ সুযোগটি নেন। ২০২০-২১ অর্থবছরে এযাবৎকালের এক বছরে সর্বোচ্চ ২০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা সাদা হয়। সেবার জমি-ফ্ল্যাট কিনে ও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে কিংবা নগদ টাকা সাদা করেছেন ১১ হাজার ৮৫৯ জন ব্যক্তি।