বিশেষ প্রতিনিধি : গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে টানা দেড় দশকের আওয়ামী রাজত্বের পতন ঘটেছে। ক্ষমতাচ্যুতির পর দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলীয় ও সরকারপ্রধানের দেশত্যাগের খবরে গা ঢাকা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরাও। আত্মগোপনে থাকা এমন কয়েকজন উচ্চপর্যায়ের নেতার সঙ্গে কথা বলেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।
আওয়ামী সরকারের পতন নিয়ে নানা ব্যাখ্যা দিয়েছেন তারা। তাদের বর্ণনায় সবচেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে ‘গ্যাং অব ফোর’ নামে একটি অভ্যন্তরীণ স্বার্থগোষ্ঠীর কথা। যারা শেখ হাসিনার পতনে নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে মনে করছেন তারা।প্রতিবেদন অনুসারে, গ্যাং অব ফোরের সদস্যরা হলেন- শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ-বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, চারজনের এই দল তার (শেখ হাসিনা) পতনে নেতৃত্ব দিয়েছে। এদের ওপর তার ছিল অন্ধবিশ্বাস। ফলে তার যে সহজাত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল, তাদের কারণে তিনি হারিয়েছেন। গোষ্ঠীটি তাকে বাস্তব অবস্থা বুঝতে দেয়নি।
আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা এবার ক্ষোভ ঝাড়লেন শেখ হাসিনার ওপর। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়। গত এক সপ্তাহে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে ভারতীয় এই সংবাদমাধ্যমটি।‘হাসিনা দল ও দলের মানুষদের পরিত্যাগ করেছেন’, ‘আপা (শেখ হাসিনা) আমাদের ছেড়ে গেছেন’—ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদকের কাছে এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন এসব নেতারা। দেশত্যাগ করার আগমুহূর্তেও কাউকে জানিয়ে যাননি। এমনকি ঘনিষ্ঠরাও জানতেন না। আর নেতারা এই খবর টিভি থেকে জানতে পেরেছেন বলে জানান।
শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবরে যেন আকাশ ভেঙে পড়ে আওয়ামী নেতাদের ওপর। জনতার ক্ষোভ এসে পড়ে তাদের ওপর। বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা করা হয়। কয়েকজন নেতার মৃত্যুর খবরও পাওয়া যায়। আহত হন অনেকে। ওই সময়ের কথা মনে করে নেতারা বলেন, ‘বের হয়ে কোথাও যাওয়ার সুযোগ ছিল না। সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে কথা বলার সময় একটু সুযোগ পাই বের হওয়ার। আমাদেরকে পেলে মেরে ফেলা হতো।’
শেখ হাসিনাকে কি দেশে আনা যাবে, ভারতের সাথে চুক্তি কী বলছে?শেখ হাসিনাকে কি দেশে আনা যাবে, ভারতের সাথে চুক্তি কী বলছে? ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বলছে, টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে বিরোধীদের ওপর চড়াও হয়েছিল শেখ হাসিনা সরকার। ওই সময় গ্রেপ্তার, নির্যাতন, গুমের শিকার হতে হয় অনেককে। কিন্তু একমুহূর্তেই সবকিছু যেন পাল্টে গেল।
গত জুলাইয়ে শিক্ষার্থী ও বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর ঘটনায় আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের এসব নেতার কেউ কেউ দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। পরে ৩-৪ আগস্ট ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। ৫ আগস্ট বিক্ষোভকারীরা কারফিউ ভাঙেন। সেদিনই সরকারের পতন ঘটে। এসব ঘটনার কারণ হিসেবে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ একটি গোষ্ঠীকে দায়ী করেছেন বেশ কয়েকজন নেতা। তারা বলেন, তিনি (শেখ হাসিনা) আমাদের কথা শোনেননি।’ এই গোষ্ঠীকে ‘গ্যাং অব ফোর’ বলে আখ্যায়িত করেন নেতাদের একজন। তিনি বলেন, গোষ্ঠীটি শেখ হাসিনাকে বাস্তব অবস্থা বুঝতে দেয়নি।
এই চার নেতা হলেন শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ (জয়), সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। ওই নেতা বলেন, ‘চারজনের এই দল তাঁর (হাসিনা) পতনে নেতৃত্ব দিয়েছে। এই ব্যক্তিদের ওপর তাঁর ছিল অন্ধবিশ্বাস। তাঁর যে সহজাত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল, তা তিনি তাঁদের কারণে হারিয়েছেন।’
গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে বিএনপিকে অংশ নেওয়ার সুযোগ না দেওয়া বড় ভুল ছিল বলে মন্তব্য করেছেন আত্মগোপনে চলে যাওয়া আওয়ামী লীগের এসব নেতা। ওই সময় কয়েকজন নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে এ নিয়ে যোগাযোগ করতে চাইলেও শেখ হাসিনা তাতে সম্মত হননি। নেতারা বলছেন, জানুয়ারির নির্বাচনে জেতার পর শেখ হাসিনা একগুঁয়ে হয়ে ওঠেন ও কোনো পরামর্শ শোনেননি। এ প্রসঙ্গে এক নেতা বলেন, ‘টানা চতুর্থবার জিতে তিনি (হাসিনা) অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। কোটা সংস্কার নিয়ে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনে সৃষ্ট ক্ষোভের মাত্রা বুঝতে ব্যর্থ হন শেখ হাসিনা।’
আওয়ামী লীগের এসব নেতা বলেন, জুলাইয়ে ছাত্রদের সঙ্গে বসে মিটমাট করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল শেখ হাসিনাকে। কিন্তু তিনি শোনেননি। পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের তুলে এনে এরপর চাপে পড়ে ছেড়ে দেওয়ার পর আর কিছুই করার ছিল না।
এই ভরাডুবির পর দল গোছানোর ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের প্রথম পদক্ষেপ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের এসব নেতার একজন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, ‘দলকে পুনর্গঠনে তাঁকে (হাসিনা) তৃণমূল পর্যায়ের লোকজন বাছাই করতে হবে, তাঁদের মধ্যে থাকবেন কিছু তরুণ আওয়ামী নেতা; মাঠপর্যায়ে যাঁদের ব্যাপারে মানুষের আস্থা আছে, লোকজনের সঙ্গে যাঁদের যোগাযোগ আছে এবং অবশ্যই পরিবারের (হাসিনা) প্রতি অনুগত থাকবেন। এতে বেশ সময় লাগবে।’
এ পরিস্থিতিতে দলের হাল ধরার বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, রুহুল কবির রিজভীর মতো কয়েকজন নেতার ভূমিকার দিকে ইঙ্গিত করেন ওই নেতা। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া কারাগারে থাকাকালে ও তারেক রহমান বিদেশে অবস্থানকালে বিএনপির দুর্গ সামলেছেন তাঁরা।দেশে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগবিরোধী মনোভাব বিরাজ করায় শেখ হাসিনার পরিবার ও এর উত্তরসূরি সজীব ওয়াজেদ জয়ের খুব কম বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন দলটির নেতারা।