ঢাকায় পাতাল রেলের স্বপ্ন
শফিক রহমান : যানজট মোকাবেলায় রাজধানী ঢাকায় পাতাল রেলের স্বপ্ন দেখাচ্ছে সরকার। স্বপ্ন সত্যির প্রত্যাশা সারা দেশবাসীর। দৃশ্যমান পদ্মা সেতুর মত পাতাল রেলও দেখতে চায় দেশবাসী।পাতাল রেল হলে ঢাকায় যানজট কমবে সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু এর যে খরচ তা নিয়ে চলছে নানা বিপত্তি। নগর পরিকল্পনাবিদরা বিপুল অংক ব্যয় করে পাতাল রেলে নাখোশ। অনেকে বলছেন, মাত্র এক হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে মাটির ওপর পরিবহনব্যবস্থা ঠিক করা যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাতাল রেলে প্রথমেই ব্যয় হবে ব্যয় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা। এখানেই শেষ নয়-। পুরো ঢাকাকে পাতাল রেলের আওতায় আনতে আপাতত খরচ ধরা হয়েছে আট লাখ ৮২ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের প্রায় দেড় গুণ। তবে প্রথম ধাপে চার রুট নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় তিন লাখ ৫৪ হাজার ৫২১ কোটি টাকা।পাতাল রেলের সম্ভাব্যতা নিয়ে সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সাবওয়ের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছে সেতু কর্তৃপক্ষ।
বিভিন্ন সমিক্ষ্যায় জানা গেছে, ঢাকার জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, ২০৭০ সালে গণপরিবহন ব্যবস্থা সেটা সামাল দিতে পারবে না। এমনকি মেট্রো রেল ও বাস র্যাপিড ট্রানজিটের (বিআরটি) মতো প্রকল্পও হিমশিম খাবে। তাই যানজট নিরসনের উপায় হিসেবে পাতাল রেল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
তবে নগর পরিকল্পনাবিদরা এটাকে বাহুল্য করচ বলছেন। স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘লাখ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে মাটির নিচে ট্রেন চালানোর চিন্তা করছি। অথচ মাত্র এক হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে মাটির ওপর পরিবহনব্যবস্থা ঠিক করা যায়। আমরা কেন বিদ্যুতনির্ভর এত ব্যয়বহুল প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছি, সেই প্রশ্ন তোলা উচিত। আবার নগরে গণপরিবহন পরিচালনার রাজউকের যে পরিকল্পনা, তাতে পাতাল রেলের কোনো উল্লেখ নেই।
যাহোক, ঢাকা মহানগরে স্বপ্নের পাতাল রেল (সাবওয়ে) নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ২০৫০ সালে ঢাকায় মাটির নিচ দিয়ে রেল চলাচল করবে। এতে মোট ১১টি রুট থাকবে। তবে প্রাথমিকভাবে ২০৩০ সালে চারটি রুট চালুর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।চার রুট নির্মাণে ব্যয় হবে দেশের চলতি অর্থবছরের মোট বাজেটের অর্ধেকের বেশি। তবে স্বপ্নের প্রকল্প নিয়ে স্বপ্ন দেখতেই খরচ হয়ে যাচ্ছে ৩২১ কোটি টাকা। সরকার এখন প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করছে। চলতি বছরের জুনে সম্ভাব্যতা যাচাই ও প্রাথমিক নকশার কাজ শেষ হবে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩১৭ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে পরামর্শক খাতে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) সম্ভাব্যতা যাচাই ও প্রথমিক নকশা তৈরির কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে স্পেনের টিপসা। ১১টি রুটের মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ১০৫ কিলোমিটার দীর্ঘ চারটি রুট ২০৩০ সালের মধ্যে নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
বলা হচ্ছে, সাবওয়ে নির্মাণে জমি অধিগ্রহণ ও নির্মাণজনিত কোনো ঝামেলা নেই। সাবওয়েটি নির্মিত হলে ঢাকা মহানগরের প্রায় ৮০ লাখ কর্মজীবীর অর্ধেক মাটির নিচ দিয়ে যাতায়াত করতে পারবেন। এতে নগরে যানজট কমবে। মেট্রো রেলের মতোই পাতাল রেল পুরোপুরি বিদ্যুনির্ভর থাকবে। চলবে মেট্রো রেলের মতো একই পদ্ধতিতে চলবে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে বুলেট ট্রেন চালানোর স্বপ্ন দেখেছিল সরকার। সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে কি না তা পরীক্ষা করতে রেলওয়ে একটি প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পের যেসব কাজ হয় তাকে কারিগরি ভাষায় সম্ভাব্যতা যাচাই বলে। সেই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে প্রায় ১০০ কোটি টাকা খরচ হয়। এরপর রেলওয়ে ঘোষণা দেয়, বাংলাদেশ এই মুহূর্তে বুলেট ট্রেন চলাচলের জন্য উপযুক্ত নয়। অথচ সরকারের এই বুলেট স্বপ্ন দেখতে ১০০ কোটি টাকা খরচ হয়। এখন পাতাল রেল চালানোর যে স্বপ্ন দেখা হচ্ছে, তা বাস্তবে রূপ নেবে কি না সেটা বোঝা যাবে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর। আর এই সম্ভাব্যতা যাচাই করতেই খরচ হচ্ছে ৩১৮ কোটি টাকা।
ঢাকায় পাতাল রেলের জন্য প্রথম দিকে চার রুট নির্ধারন করা হয়েছে। পাতাল রেল রুট-১ হচ্ছে : কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল থেকে টঙ্গী জংশন পর্যন্ত। এই ৩৫ কিলোমিটার পথে থাকবে মোট ২৪টি স্টেশন। ঝিলমিল, তেঘরিয়া বাজার, মুসলিমনগর, সদরঘাট, গুলিস্তান, কাকরাইল, হাতিরঝিল, বিজি প্রেস, রজনীগন্ধা মার্কেট, ভাসানটেক সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, কালশী, উত্তরা সেক্টর-১৭, নর্থ বাউনিয়া, উত্তরা সেক্টর-১৪, উত্তরা সেক্টর-১০, মাছিমপুর ও টঙ্গী জংশন এলাকায় স্টেশন করা হবে।
পাতাল রেল রুট-২ হচ্ছে: গাবতলী থেকে ভেলাব ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রায় ২৩ কিলোমিটার এলাকায় ১৪টি স্টেশন হবে। গাবতলী, গোলারটেক, তুরাগ সিটি, জাতীয় চিড়িয়াখানা, পূর্বাচল, গাবতলী-ভেলাব ইউনিয়ন সেক্টর-১১, পূর্বাচল সেক্টর-২১, পূর্বাচল সেক্টর ইস্ট, পূর্বাচল মালুম সিটি ও ভেলাব ইউনিয়নে স্টেশন হবে।
পাতাল রেল রুট-৩ হচ্ছে : কেরানীগঞ্জ থেকে সোনাপুর প্রায় সাড়ে ২৬ কিলোমিটারে ১৫টি স্টেশন হবে। কেরানীগঞ্জ, কামরাঙ্গীর চর, লালবাগ, চকবাজার, নয়াবাজার, কেরানীগঞ্জ-সূত্রাপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, দনিয়া, রায়েরবাগ, মাতুয়াইল, সাইনবোর্ড, সানারপাড়, মৌচাক, চিটাগাং রোড, কাঁচপুর ও সোনাপুরে স্টেশনগুলো তৈরি হবে।
পাতাল রেল রুট-৪ হচ্ছে : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া পর্যন্ত ৪৫ কিলোমিটার এলাকায় ৩২টি স্টেশন হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, আশুলিয়া মডেল টাউন ইস্ট, উত্তরা সেক্টর-১৬, উত্তরা নর্থ, আজমপুর কাঁচাবাজার, শাহ কবীর মাজার নর্থ, আফতাবনগর নর্থ, ওয়েস্ট নন্দীপাড়া, গ্রিন মডেল টাউন, মাতুয়াইল রোড, নন্দিপাড়া দক্ষিণ, বরুয়া সাউথ, বসুন্ধরা সাউথ, সান ভ্যালি উত্তর পাড়া, শনির আখড়া, রায়েরবাগ, ইস্ট মোহাম্মদবাগ, ফতুল্লা স্টেশন, ডিসি অফিস নিউ কোর্ট ও নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া এলাকায় হবে রেলস্টেশন।
এই চার রুটের মধ্যে ঝিলমিল থেকে টঙ্গী পর্যন্ত প্রায় ৩৫ কিলোমিটার রুটে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে দুই হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা। গাবতলী থেকে ভোলাব ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রায় ২৩ কিলোমিটার পথে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে দুই হাজার ১৫৮ কোটি টাকা। কেরানীগঞ্জ-সোনাপুর প্রায় সাড়ে ২২ কিলোমিটার পথে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে দুই হাজার ২১৭ কোটি টাকা। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ৪৫ কিলোমিটার রুটে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা।