মানহানির আসামী হাজিরা ২৮ নভেম্বর-
উর্মিকে সেলুট দিলেন জেড আই খান পান্না-
রাষ্ট্র সংস্কার নিয়েই প্রশ্ন তুললেন এক্স এমপি রনি-
বিশেষ প্রতিনিধি : অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে ফেসবুকে বিতর্কিত পোস্ট দিয়ে সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার পর মামলার আসামী হয়েছেন লালমনিরহাট জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাপসী তাবাসসুম ঊর্মি। আবু সাঈদসহ নিহত অন্যদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্যের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত সহকারী কমিশনার তাপসী তাবাসসুম উর্মির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা গ্রহণ করেছেন আদালত। একই সঙ্গে তাকে ২৮ নভেম্বর আদালতে হাজির হতে সমন জারি করা হয়েছে।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, তাপসী তাবাসসুম উর্মি বাক স্বাধীনতার বলি নন। তিনি সরকারের শৃঙ্খলাবিধি ভঙ্গ করেছেন। আর এ যৌক্তিক কারণেই তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী হিসেবে তার হওয়ার কথা পক্ষপাতহীন। কিন্তু তিনি স্বৈরশাসকের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে দেয়া এক পোস্টে তিনি এসব কথা বলেন।
এছাড়া ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সমালোচনা করে আলোচিত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাপসী তাবাসসুম উর্মির পক্ষ নেওয়ায় সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্নার সমালোচনা করে শফিকুল আলম লিখেছেন, আইনজীবী জেড আই খান পান্না তাকে সেলুট জানিয়েছেন। কয়েকদিন আগে পান্না অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে বর্জ্য বলে সমালোচনা করেছিলেন। আমি অবাক হইনি। সারাজীবনই তিনি খুবই গড়পড়তা মানের একজন আইনজীবী ছিলেন। তবে কোনোভাবে তিনি শোরগোল তৈরিতে ওস্তাদ। হয়ত এ কারণেই তিনি আজকের এ অবস্থানে এসেছেন।
মঙ্গলবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসেনের আদালতে গণঅধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদ সদস্য ও গণমাধ্যম সমন্বয়ক আবু হানিফ বাদী হয়ে মামলাটি করেন। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে আসামিকে ২৮ নভেম্বর আদালতে হাজির হতে সমন জারি করেছেন। বাদীপক্ষের আইনজীবী মো. খাদেমুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
মামলার আবেদনে বলা হয়েছে, গত ৫ অক্টোবর আসামি উর্মি শুধু শহীদ আবু সাঈদ নয়, সরকারের দায়িত্বশীল পদে থাকা সত্ত্বেও ছাত্র-গণআন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সরকার ও সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধেও অবমাননাকর বক্তব্য ফেসবুক লেখেন। যার মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রেফারেন্সের ভিত্তিতে সংবিধান সম্মতভাবে গঠিত একটি সরকারপ্রধান সম্পর্কে বিষোদগার করা হয়েছে এবং সরকার উৎখাতের হুমকি দিয়ে জনমনে ভীতি সৃষ্টি করা হয়েছে।
এদিকে প্রশ্ন উঠেছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সবাই যখন চুপ, তখন কেন প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মকর্তা হয়ে এ ধরনের মন্তব্য করতে কেন সাহস দেখালেন তিনি।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সরকারি চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ঊর্মি। তিনি ঠিক করেছেন বিদেশে গিয়ে ক্যারিয়ার গড়বেন। সেজন্য ১ সেপ্টেম্বর রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার থেকে পাসপোর্টের জন্য এনওসি নেন তিনি। সম্প্রতি তিনি ‘হায়ার স্টাডি অ্যাবরোড’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে তাকে যুক্ত হতে দেখা যায়।
অভিযোগ উঠেছে, দ্রুত চাকরি থেকে বের হওয়ার পাশাপাশি বাইরে ভিসা পাওয়া কিংবা প্রয়োজনে অ্যাসাইলাম পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করতে ঊর্মিকে একটু কঠোর পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। প্রথমে জনরোষ তৈরি করতে তিনি আবু সাইদকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। কিন্তু তার ফেসবুক প্রোফাইল লক থাকায় সেটা বেশি মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। কিন্তু এবার প্রধান উপদেষ্টাকে নিয়ে তার পোস্টটি ভাইরাল হয়ে যায়।
প্রধান উপদেষ্টাকে নিয়ে তাপসী তাবাসসুম ঊর্মি তার আইডিতে লিখেছেন, ‘সাংবিধানিক ভিত্তিহীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, রিসেট বাটনে পুশ করা হয়েছে। অতীত মুছে গেছে। রিসেট বাটনে ক্লিক করে দেশের সব অতীত ইতিহাস মুছে ফেলেছেন তিনি। এতই সহজ। কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে আপনার, মহাশয়।’
এই পোস্টটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সমালোচনায় মুখে পড়েন ঊর্মি। এ ঘটনায় রোববার (৬ অক্টোবর) ঊর্মিকে ওএসডি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। এরপর সোমবার (৭ অক্টোবর) তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।এরই মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কটূক্তি ও আবু সাঈদকে ‘সন্ত্রাসী’ বলার আরও কয়েকটি স্ট্যাটাস ভাইরাল হয় ঊর্মির। এর প্রতিবাদে সোমবার মানববন্ধন করেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থীরা। তাপসী তাবাসসুম ঊর্মিকে গ্রেপ্তারের দাবিতে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা।
এদিকে তাপসী তাবাসসুম ঊর্মির ফেসবুক আইডিতে গিয়ে দেখা গেছে, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বেশ কিছু স্ট্যাটাস দিয়েছেন তিনি। তার ফেসবুক আইডিজুড়ে আওয়ামী লীগের পক্ষেও শক্ত অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন স্ট্যাটাস দেখা গেছে। অবশ্য সোমবার দুপুরে তার আইডিতে ঢুকে কোনো কিছুই পাওয়া যায়নি। এর আগেই তিনি সব কিছু সরিয়ে ফেলেছেন।
পাসপোর্টের জন্য এনওসি ও বিদেশে ক্যারিয়ার গড়ার বিষয়ে জানতে তাপসী তাবাসসুম ঊর্মিকে ফোন করা হলে তার নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়।তবে চাকরি থেকে ওএসডি হওয়ার পর গণমাধ্যমকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় ঊর্মি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে যেকোনো জায়গা থেকে বলা যায়। এ জন্য যদি চাকরি চলে যায়, এতে আমার কোনো সমস্যা নাই।’
কীভাবে দায়িত্বশীল জায়গা থেকে এমন মন্তব্য করেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি যখন দেখবো, আমার দেশের ওপর কোনো থ্রেট চলে আসছে, দেশকে বাঁচানোর জন্য আমার যতটুকু বলা উচিত, সেই বলাটাই আমার দায়িত্বশীলতা। আমি ফ্র্যাংকলি বলি, আমি চাই না আমার দেশে কোনো মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি আসুক। আমার যাকে মনে হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি। আমি তাদেরকে সেভাবেই ট্রিট করেছি এবং সেভাবেই পোস্ট দিয়েছি।
ঊর্মি ময়মনসিংহ বিভাগের নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা উপজেলার সদর ইউনিয়নের নসিবপুর গ্রামের মো. ইসমাইল হোসেনের মেয়ে। তার বাবা ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা শহীদ স্মৃতি কলেজের সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এছাড়া তিনি ময়মনসিংহ নগরীর ঐতিহ্যবাহী আনন্দ মোহন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজসহ বিভিন্ন সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। বর্তমানে তিনি অবসর জীবনযাপন করছেন।
দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে ঊর্মি সবার বড়। তার ছোট ভাই বর্তমানে জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছেন। ঊর্মির মা নাসরিন জাহান বর্তমানে ময়মনসিংহের হাজী কাশেম আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজে গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
সোমবার মেয়ের কর্মকাণ্ড নিয়ে মুখ খুলেছেন নাসরিন জাহান। গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ঊর্মি চাকরির বিধি লঙ্ঘন করেছে। এটা তার ঠিক হয়নি। এটা একটা বড় অপরাধ।
তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধ করিনি, যুদ্ধ দেখিনি। যে যুদ্ধ হয়েছে, সেটা ইতিহাস। তবে ইতিহাসকে অস্বীকার করার উপায় নেই। আমরা আমাদের মা-বাবাকে অস্বীকার করতে পারব কি?
উর্মির মা নাসরিন জাহান আরও বলেন, ঊর্মি ছাত্রজীবনে কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল না। তবে ২০১৮ সালে কোটা আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিল। তখন তার ৪০তম বিসিএস পরীক্ষা ছিল। সে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেছে। সেখান থেকে মাস্টার্স করেছে। আমার সন্তানরা কোনো রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নেই। আমরা খুব সাধারণ জীবনযাপন করি।
তারা কিসের রাষ্ট্র সংস্কার করবেন প্রশ্ন এক্স এমপি রনির-
এদিকে তাপসী তাবাসসুম ঊর্মি বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করার প্রসঙ্গে রাষ্ট্রের সংস্কার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পটুয়াখালী-৩ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি গোলাম মাওলা রনি। সম্প্রতি লালমনিরহাট জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাপসী তাবাসসুম ঊর্মিকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায় তাকে ওএসডি করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন তাপসী তাবাসসুম। এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে গোলাম মাওলা রনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা প্রশ্ন তুলে ধরেছেন।
তিনি লিখেছেন, ‘তাবাসসুম ঊর্মিকে কেন ওএসডি করা হলো! যেখানে দালালি করার জন্য পুরস্কৃত করা হয়! দলবাজির জন্য পদোন্নতি হয়! দুর্নীতির জন্য সম্মান করা হয় সেখানে তো সরকারি চাকুরি বিধির দোহাই দেওয়া হয় না! একজন নবীন সরকারী কর্মকর্তার একান্ত ব্যক্তিগত একটি কথা যারা হজম করতে পারেন না তারা কিসের রাষ্ট্র সংস্কার করবেন! কিসের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন! শুধু মুখে মুখে লন্ডন-আমেরিকার গণতন্ত্র এবং অন্তরে উগান্ডার আমিন দাদার মতো স্বৈরাচারী মনোভাব পোষণকারীদের সঙ্গে যদি গুণগত পার্থক্য না থাকে তবে আমরা কীভাবে অগ্রসর হবো!’