অনলাইনে ব্রেন রট- মস্তিষ্কের কার্যকারিতায় প্রভাব ফেলছে
লাবণ্য চৌধুরী : অনলাইনে ‘ব্রেন রট’ মস্তিষ্কের কার্যকারিতায় প্রভাব ফেলছে। দেখা যাচ্ছে অনেকে কোন ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম থেকে ক্রমাগত তথ্য বা কন্টেন নিচ্ছে। অনেকে তা বাছাই ছাড়াই বিশ্বাস করে ফেলছে। বর্তমানে এসব কন্টেন নেয়া ও তা বিশ্বাস করার প্রবণতা উদ্বেগজনকহারে বাড়ছে। ইন্টারনেট সংস্কৃতিতে এই বিপজ্জনক প্রবণতাকে মস্তিষ্কের অবক্ষয়, মস্তিষ্ক পচা বা ‘ব্রেন রট’ বলা হয়। নিম্নমানের বা আবেগীয় কোনো বিষয়বস্তুর (কন্টেন্ট) মাধ্যমে সৃষ্ট নেতিবাচক মনস্তাত্ত্বিক এবং জ্ঞানীয় প্রভাবকে ব্রেন রট বলা হচ্ছে। ডিজিটাল মিডিয়ার অত্যধিক ব্যবহার ও আসক্তি এর একটি বৈশিষ্ট। শব্দটি জেনারেশন আলফা এবং জেনারেশন জেডের অনলাইন সংস্কৃতি থেকে সৃষ্ট। কিন্তু এরপর এটি অন্য বয়সীদেরকেও প্রভাবিত করছে।
এতে মূলত উঠতি বয়সী, তরুণ-তরুণী এবং যুবক-যুবতীদের মাঝে পড়াশোনা ও কাজে মনোযোগের অভাব, আত্মবিশ্বাসের কমতি এবং মানসিক ক্লান্তি প্রকট হচ্ছে। পাশাপাশি চাপ, হতাশা এবং উদ্বেগের মতো সমস্যাও গভীর হচ্ছে। যা তাদের মস্তিষ্কের কার্যকারিতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
অক্সফোর্ডের বর্ষসেরা শব্দ ‘ব্রেন রট’: এ বছর অক্সফোর্ডের বর্ষসেরা শব্দ নির্বাচিত হয়েছে ‘ব্রেন রট’ শব্দটি। ২ ডিসেম্বর বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ৩৭ হাজার মানুষের ভোটে এ শব্দ বেছে নেয়া হয়েছে। ব্রেন রটের পাশাপাশি সেরা শব্দের সংক্ষিপ্ত তালিকায় রয়েছে ডিমিউর, ডাইনামিক প্রাইসিং, স্লোপের মত শব্দগুলো।
সামাজিক মাধ্যমে নিম্নমানের কন্টেন্ট দেখার হার বেড়ে গেলে মানুষের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থার অবনতি বোঝাতে ব্রেন রট শব্দটি ব্যবহার করা হয়। চলতি বছরে শব্দটির ব্যবহার ২৩০ শতাংশ বেড়েছে বলে জানায় অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। ইন্টারনেট যুগে জেন জি ও জেন আলফাদের মাঝে প্রথম এই শব্দ জনপ্রিয়তা পাওয়া শুরু করে। তবে এখন মূলধারায় ব্যাপকহারে ব্যবহৃত হচ্ছে শব্দটি।
ব্রেন রট শব্দের ব্যবহার প্রথমবারের মতো ১৮৫৪ সালে মার্কিন দার্শনিক হেনরি ডেভিড তার বইয়ে উল্লেখ করেছিলেন। তবে সেসময় এর অর্থ ছিল ভিন্ন। জটিল ধারণা এবং অভিনব আইডিয়ার প্রতি সাধারণ মানুষের অনাগ্রহ এবং এ কারণে তাদের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থার অবনতি ঘটছে বলে সমালোচনা করছিলেন তিনি।
টিকটকে ব্রেন রটের হ্যাশট্যাগ প্রায় পাঁচ লাখের বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিভাগের প্রধান জানান, শব্দটি ভার্চুয়াল জীবনের নানা ক্ষতিকর দিকের প্রতিফলন করে থাকে।
দ. এশিয়ার দেশগুলোতে ‘ব্রেন রট’ এর বিপজ্জনক প্রভাব: দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এই ব্রেন রট-এর নেতিবাচক প্রভাব দিন দিন আরও তীব্রতর হচ্ছে। এবং এর পরিণতি হিসেবে মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত উদ্বেগও বাড়ছে।
এসব দেশে মূলত সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম মাত্রাতিরিক্ত ও নিম্নমানের কন্টেন্ট যেমন ভিডিও,টেক্স ও ছবিতে সয়লাব হয়ে গেছে। এসব দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সামাজিক মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার, বিনোদননির্ভর মানহীন কনটেন্টের ওপর নির্ভরশীলতা এবং ডিজিটাল স্ক্রলিং-এর অভ্যাস এই সমস্যাকে তীব্রতর করেছে। এই খারাপ স্বভাবটির জন্য বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের যুবসমাজের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া গেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত এবং বাংলাদেশে ‘ব্রেন রট’ সমস্যার উপস্থিতি বেশি লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে ভারতের প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলেন, জেন-জেড এবং আলফা প্রজন্মের মধ্যে সামাজিক মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার তাদের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাংলাদেশেও এই প্রবণতা আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে। মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতা এবং অনলাইনভিত্তিক প্ল্যাটফর্মের বাড়তি সুবিধা এবং ব্যবহার বাংলাদেশি তরুণ সমাজকে ‘ব্রেন রট’-এর দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা টিকটক, ফেসবুক রিলসের মতো প্ল্যাটফর্মে কম সময়ে বিনোদনমূলক কিন্তু মানহীন কনটেন্টের প্রতি ঝুঁকছে। এতে তাদের মনোযোগ, সৃজনশীলতা এবং মানসিক শক্তি কমে যাচ্ছে।
পাকিস্তানের যুবসমাজেও ‘ব্রেন রট’ উল্লেখযোগ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষত সামাজিক মাধ্যমের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এবং ডিজিটাল কনটেন্টের দৌরাত্ম্যের কারণে।
এই তিন দেশছাড়াও গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় এই সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। ডিজিটাল ওয়াচ অবজারভেটরি-এর বিশ্লেষণে এসব উল্লেখ করা হয়েছে।বিশিষ্টজন ও বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যে দক্ষিণ এশিয়ায় ‘ব্রেন রট’-এর প্রভাব সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি উঠে এসেছে। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. লোরেন স্ট্রাউস জানিয়েছেন, সামাজিক মাধ্যম অতিরিক্ত ব্যবহারে উঠতি বয়সী এবং তরুণদের মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমে যাচ্ছে। প্রায় ২০০ কোটি মানুষের নিবাস দক্ষিণ এশিয়া যেখানে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে মানসিক চাপ বেশি থাকে, সেখানে এই ধরনের মানহীন ডিজিটাল কন্টেন্টের দৌরাত্ম্য শিক্ষার্থীদের মনোযোগ কমিয়ে দিচ্ছি। বাড়িয়ে দিচ্ছে মানসিক অবসাদ।
দ্য এ্যাংসাস জেনারেশন বইয়ের লেখক ড. জোনাথন হেইডট বিশেষ করে ভারতের উঠতি বয়সীদের কথা উল্লেখ করে জানিয়েছেন, ভারতের মতো দেশে ডিজিটাল মাধ্যমের সহজলভ্যতা কিশোর-কিশোরীদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। এটি তাদের মধ্যে মানসিক অবসাদ এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এদিকে বাংলাদেশে তরুণ সমাজের মধ্যে ‘ব্রেন রট’ একটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়াসহ স্ক্রিনে সময়ের অপচয় এবং অর্থহীন কনটেন্টের প্রতি আসক্তি তাদের সৃজনশীলতা এবং পড়াশোনার প্রতি মনোযোগকে ব্যাহত করছে।
পাকিস্তানি মনোবিজ্ঞানী ড. শেহর বানু জানিয়েছেন, ক্রিনের ওপর নির্ভরতা পাকিস্তানের তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। বিশেষত, ‘ব্রেন রট’-এর মতো সমস্যাগুলো তাদের সৃজনশীলতা ও বিশ্লেষণী চিন্তার ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। ভারতীয় শিক্ষাবিদ ড. দেবী প্রসাদ রায় সতর্ক করে জানিয়েছেন, টিকটক এবং রিলসের মতো প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার শিক্ষার্থীদের বই পড়ার অভ্যাস ধ্বংস করে দিয়েছে এবং এটি তাদের দীর্ঘমেয়াদী মানসিক উন্নয়নের জন্য বড় হুমকি।
বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মত দিয়েছেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ‘ব্রেন রট’-এর প্রভাব উঠতি বয়সী এবং পরবর্তী প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাগত পারফরম্যান্সে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই সমস্যার সমাধানের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি, পরিবারভিত্তিক ডিজিটাল নিয়ন্ত্রণ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রযুক্তি ব্যবহার সংক্রান্ত নীতিমালা প্রয়োজন।