তাহলে তিন্নির খুনী কে? সেই অভি খালাস!
তিন্নির বাবা মাহবুবুল করিম আদালতের সাক্ষ্যে বলেছিলেন, তিন্নির সঙ্গে তিনি অভিকে প্রথম দেখেছিলেন হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিন আগে ৫ নভেম্বর পিয়াল ও তিন্নির বাসায়। সেদিন তিন্নি তাকে বলেছিলেন যে তিনি অভিকে বিয়ে করতে চান। মাহবুবুল করিম বলেন, “আমি তিন্নিকে তার স্বামী পিয়ালের কথা বলি। তাকে বলি, এখন তুমি কীভাবে অভিকে বিয়ে করবা? তিন্নি বলে, ‘আমি পিয়ালের সাথে থাকতে চেয়েছি, কিন্তু সে আমাকে ধরে রাখতে পারেনি’।
সেখানে পিয়ালও ছিলেন জানিয়ে মাহবুবুল সাক্ষ্যে বলেন, অভি সেদিন পিয়ালকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, তিনি যেন তিন্নিকে ডিভোর্স দিয়ে দেন। সেদিন অভি মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তাকেও হুমকি দিয়েছিলেন বলে তিন্নির বাবা সাক্ষ্যে জানান।
শফিক রহমান : অবশেষে ২৩ বছর পর রায় হলো মডেল তিন্নি হত্যার। কিন্তু রহস্যর বিষয়-যিনি একমাত্র প্রধান আসামি সাবেক এমপি অভি তিনিই খালাস। তাহলে প্রশ্ন উঠেছে কে মেরিছিল তিন্নিকে? আর তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ কেনই বা খুনীকে চিহ্নিত করতে পারল না? নাকি তলে তলে সব ম্যানেজ করেছিল আসল খুনীরা?
দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন এর অনুসন্ধানে মিলেছে, তিন্নির লাশ পড়েছিল ঢাকার পোস্তগোলায় বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর নিচে পিলারের উঁচু জায়গায়। সন্দেহ নেই ওপর থেকেই লাশ ফেলে দেয়া হয়েছিল।কিন্তু ওই সময় কে এই হতভাগ্য তরুণী, তার নাম-পরিচয় জানা যাচ্ছিল না তখন।
অবশেষে ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর লাশ উদ্ধারের কয়েকদিন পর জানা গেল, নিহত তরুণী সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি। মডেল হিসাবে টিভির পর্দায় কিংবা সংবাদপত্রের পাতায় তার ছবি সবার সামনে থাকলেও অপমৃত্যু তার চেহারা অচেনা করে তুলেছিল।তখন পরিচয় জানা গেলেও খুনি কে, তা জানা যাচ্ছিল না। তাই অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মামলা করেন কেরানীগঞ্জ থানার তৎকালীন এএসআই মো. সফি উদ্দিন।
তদন্ত শুরুর কিছুদিন পরই অভিযোগের আঙুল ওঠে গোলাম ফারুক অভির দিকে। ৮০ এর দশকে ছাত্রদলের এই দাপুটে নেতা ততদিনে দল পাল্টে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে সংসদ সদস্যও হয়ে গেছেন।
পরে বেশ কয়েকজন তদন্ত কর্মকর্তার হাত ঘুরে সিআইডি কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর অভিকে একমাত্র আসামি করে মামলাটিতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।দু্ই বছর পর পলাতক অভিকে অভিযুক্ত করে ২০১০ সালের ১৪ জুলাই শুরু হয় এই মামলার বিচার। তারও ১৪ বছর পর ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৬ জনের সাক্ষ্য নিয়ে বুধবার রায় দিয়েছে আদালত।
মডেল সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি হত্যা মামলায় জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভিকে খালাস দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত। মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মোছা. শাহীনুর আক্তার এ রায় ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রপক্ষ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় আদালত তাকে খালাস দেন।এ মামলায় অভি পলাতক। তার পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী শাহ্ ইলিয়াস রতন সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
এদিকে রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ মো. আবু জাফর রিজভী। পূর্ণাঙ্গ রায় দেখে আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানান তিনি।
তখনকার জনপ্রিয় মডেল অভিনেত্রী তিন্নি হত্যার প্রায় দুই যুগ পর আজ রায় হলো। তিন্নির মৃত্যুর ঘটনা রহস্যজনক এবং তা বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।
২০০২ সালের ১০ নভেম্বর রাতে কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর ১ নম্বর চীন মৈত্রী সেতুর ১১ নম্বর পিলারের পাশে মডেল তিন্নির মরদেহ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় পরদিন অজ্ঞাত আসামির বিরুদ্ধে মামলা করেন কেরানীগঞ্জ থানার তৎকালীন সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মো. সফি উদ্দিন।
এ মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ওই থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. কাইয়ুম আলী সরদার। এরপর তিন্নির মরদেহের ছবি পত্রিকায় ছাপা হলে তিন্নির এক আত্মীয় মরদেহ শনাক্ত করেন।২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর সাবেক ছাত্রনেতা ও সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভিকে একমাত্র আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ।
ফ্ল্যাশব্যাক-
তিন্নির সুরতহাল প্রতিবেদনে লাশের শরীরের বিভিন্ন অংশে থেঁতলানো জখমের কথা উল্লেখ ছিল। মাথার খুলিতে ছিল ভোঁতা অস্ত্রের আঘাত। আঘাতের চিহ্ন দেখে পুলিশ নিশ্চিত হয় যে এটি হত্যাকাণ্ড। এএসআই শফিউদ্দিনের করা মামলায় বলা হয়েছিল, আগের দিন রাতের আঁধারে অজ্ঞাতনামা তরুণীকে হত্যা করে লাশ গোপন করার জন্য বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচে ফেলে দেওয়া হয়।
মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গ থেকে লাশটি আঞ্জুমান মুফিদুলকে দেওয়ার সময় তুলে রাখা ছবি ২০০২ সালের ১৫ নভেম্বর দৈনিক জনকণ্ঠে ছাপা হয়েছিল। পত্রিকায় ওই ছবি দেখে তিন্নির চাচা সৈয়দ রেজাউল করিম জানান যে নিহত তরুণী তারই ভাইয়ের মেয়ে। তিনি একটি সাধারণ ডায়েরি করার পর তিন্নির লাশ কবর থেকে তোলা হয়, পরে পারিবারিকভাবে পুনরায় দাফন করা হয়।
জনকণ্ঠের সেদিনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সাত দিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন তিন্নি। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাকে পাচ্ছিল না পরিবার। তিন্নির স্বামী সাফকাত হোসেন পিয়ালও কিছু বলতে পারছিলেন না।
কে এই তিন্নি-
তিন্নি বিজ্ঞাপনচিত্রের পরিচিত মুখ হয়ে উঠছিলেন তখন; পাশাপাশি নাটকও করতেন। ‘আনন্দ মেলা’ নামে একটি অনুষ্ঠানের শুটিংয়ের কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন তিনি।তিন্নির বাবার নাম সৈয়দ মাহবুবুল করিম, তার বাসা ঢাকার কলাবাগানে।ফ্যাশন ডিজাইনার স্বামী পিয়ালের সঙ্গে তখন তিন্নির দাম্পত্য কলহের খবর এসেছিল জনকণ্ঠে। তিনি বাসা ছেড়ে ফুপুর বাসায় উঠেছিলেন। সেখান থেকে বেরিয়েই নিখোঁজ হন তিনি। পাঁচ দিন পর তিন্নির পরিচয় শনাক্ত হলে খবর ছাপায় সংবাদপত্রে।
তিন্নি হত্যা মামলায় অভি’র সংশ্লিষ্ঠতা-
২০০২ সালের ২৪ নভেম্বরই তিন্নি হত্যামামলার তদন্তভার পায় সিআইডি। প্রথমে তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির পরিদর্শক সুজাউল হক। পরে একে একে আসেন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) গোলাম মোস্তফা, এএসপি আরমান আলী, এএসপি কমল কৃষ্ণ ভরদ্বাজ। সবশেষে আসেন এএসপি মোজাম্মেল হক। তদন্ত কর্মকর্তারা তিন্নির গৃহকর্মী, গাড়িচালকসহ নানাজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অভির সংশ্লিষ্টতা পেয়েছিল।
তদন্তকারীরা জানতে পারেন, তিন্নির সঙ্গে অভির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠছিল। সেই কারণে তিন্নির সঙ্গে তার স্বামী পিয়ালের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তিন্নি অভিকে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়ায় তাকে খুনের শিকার হতে হয়।সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা মোজাম্মেল হকই ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর অভিকে একমাত্র আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। এরপর ২০১০ সালের ১৪ জুলাই অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিচার। অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয় ৪১ জনকে।২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর তিন্নি হত্যা মামলায় রায়ের তারিখ ধার্য করেছিল আদালত। কিন্তু সেদিন গুরুত্বপূর্ণ দুই সাক্ষী তিন্নির বাবা ও চাচা সাক্ষ্য দিতে চাইলে আদালত রায় মুলতবি করে পুনরায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু করে।
তিন্নির স্বামী পিয়াল কে অভির ধমক-
তিন্নির বাবা মাহবুবুল করিম আদালতের সাক্ষ্যে বলেছিলেন, তিন্নির সঙ্গে তিনি অভিকে প্রথম দেখেছিলেন হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিন আগে ৫ নভেম্বর পিয়াল ও তিন্নির বাসায়। সেদিন তিন্নি তাকে বলেছিলেন যে তিনি অভিকে বিয়ে করতে চান। মাহবুবুল করিম বলেছলেন, “আমি তিন্নিকে তার স্বামী পিয়ালের কথা বলি। তাকে বলি, এখন তুমি কীভাবে অভিকে বিয়ে করবা? তিন্নি বলে, ‘আমি পিয়ালের সাথে থাকতে চেয়েছি, কিন্তু সে আমাকে ধরে রাখতে পারেনি’।
সেখানে পিয়ালও ছিলেন জানিয়ে মাহবুবুল সাক্ষ্যে বলেন, অভি সেদিন পিয়ালকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, তিনি যেন তিন্নিকে ডিভোর্স দিয়ে দেন। সেদিন অভি মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তাকেও হুমকি দিয়েছিলেন বলে তিন্নির বাবা সাক্ষ্যে জানান। তারপর আর তিন্নির বাসায় যাননি জানিয়ে মাহবুবুল বলেছিলেন, ১০ তারিখ সন্ধ্যার পর তিন্নি বাসায় এসে ১০ মিনিটের মতো ছিলেন। তাকে ‘সরি’ বলে চলে যাওয়ার সময় বলেছিলেন, অভির কাছে যাচ্ছেন তিনি।
মাহবুবুল বলেন, “পরে আমরা পত্রিকায় এবং মানুষের মুখে শুনতে পারি যে অভিই হত্যা করেছে তিন্নিকে। তিন্নির লাশ যেদিন পত্রিকায় ছাপা হয়, সেদিন সকাল বেলা কলাবাগানে অভির সাথে আমার ভাইয়ের দেখা হয়। অভি বলে- ‘তিন্নিকে খুঁজতে হবে না।”
অভিযুক্ত সেই গোলাম ফারুক অভি-
তিন্নি যখন খুন হন, তখন অভি সংসদ সদস্য ছিলেন না। কারণ ১৯৯৬ সালে জিতলেও ২০০১ সালের নির্বাচনে হেরে যান তিনি। তিন্নি খুনে তার জড়িত থাকার ইঙ্গিত মেলার পর তিনি দেশ ছাড়েন। খুনের এই মামলার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়ায় রাষ্ট্রীয় খরচে তার জন্য আইনজীবী নিযুক্ত করা হয়েছিল।পরে খবর আসে যে অভি কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন। অভির জন্য বাংলাদেশ পুলিশ ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিসও জারি করেছিল।
২০০৯ সালে অভি দেশে ফেরার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমার আবেদন করেন। তার মা হাই কোর্টে একটি রিট আবেদনও করেন, যাতে দেশে ফিরতে অভিকে বাধা দেওয়া হয়। তবে সফল হয়নি সেই চেষ্টা। বিএনপি সরকার আমলে ১৯৯৩ সালে অস্ত্র মামলায় অভির ১৭ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। তিন বছর কারাভোগের পর জামিন পেয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডে যুক্ত হয়ে লাপাত্তা ছিলেন অভি।