
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হলেও এর গঠন, কাঠামোগত বিষয় ও সময়সীমা নিয়ে বিভিন্ন রকম মতামত উঠে আসার কথা বলেছেন আলী রীয়াজ
বিশেষ প্রতিনিধি : সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে বিশেষায়িত কমিটি গঠনের বিষয়ে সব দলের একমত হওয়ার কথা তুলে ধরে একে বড় ধরনের সাফল্য বলছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ। এছাড়া নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হলেও এর গঠন, কাঠামোগত বিষয় ও সময়সীমা নিয়ে বিভিন্ন রকম মতামত উঠে আসার কথা বলেছেন তিনি। বুধবার রাজধানীর বেইলী রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কমিশনের আলোচনা শেষে আলী রীয়াজ এসব কথা বলেন। দুই দিন বিরতির পর এদিন ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংলাপে অষ্টম দিনের আলোচনা শেষ করেছে।
যেসব প্রস্তাবে দলগুলোর ঐকমত্য পায়নি কমিশন সেসব বিষয়ে ‘খুব দ্রুত সময়ের’ মধ্যে একটি ঐকমত্যে পৌঁছানো ‘সম্ভব’ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন কমিশনের সহসভাপতি। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই মর্মে সহযোগিতা থাকলে চলতি জুলাই মাসের মধ্যে আমরা একটি জুলাই সনদ তৈরি করতে পারব।
আলোচনার বিষয়বস্তু তুলে ধরে আলী রীয়াজ বলেন, আজকে আলোচনার মধ্য দিয়ে নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করে বড় ধরনের সাফল্য অর্জিত হয়েছে। নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সীমান নির্ধারণে যে ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছে তা তুলে ধরে আলী রীয়াজ বলেন, নির্বাচন কমিশন থেকে নির্বাচন প্রক্রিয়া ও নির্বাচনি আসন নির্ধারণ নিয়ে কাজ চলমান দেখতে পাচ্ছি। নির্বাচন সংস্কার কমিশন থেকে সুস্পষ্ট সুপারিশ ছিল, সেখানে বলা হয়েছে আশু ব্যবস্থা হিসেবে কি করা যেতে পারে। দ্বিতীয় বিষয় দীর্ঘমেয়াদী সাংবিধানিকভাবে কিছু করা।
তিনি বলেন, “দীর্ঘমেয়াদী ও স্থায়ী সমাধানে যে ঐক্যমত হয়েছে তা হলো- প্রতি আদমশুমারির অনধিক ১০ বছর পরে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের জন্য সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদের দফা এক এর ঘ শেষে আইনের দ্বারা একটি বিধান যুক্ত করা। এর অর্থ হচ্ছে সংসদীয় আসন নির্ধারণ করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা।
এই কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে আরও বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সীমানা নির্ধারণের আইন ২০২১, যেটা ২০২৫ সালে সংশোধিত হয়েছে, আমরা সংবিধানে কিছু বিষয় যুক্ত করার কথা বলেছি। তার পাশাপাশি সেটাকে বাস্তবায়ন করার জন্য কমিটির পরিধি ও কার্যপরিধি গঠন নিয়ে সুনির্দিষ্ট আইনের কথা বলেছি।সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ী সমাধানের জন্য এই ব্যাপারে সকল রাজনৈতিকদল একমত হয়েছে, বলেন কমিশনের সহসভাপতি।
তিনি বলেন, আর আশু ব্যবস্থার বিষয়ে বলা হয়েছে- ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় যথাযথ দক্ষতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে বিশেষায়িত কমিটি গঠন।কমিটি গঠন হয়ে থাকলে পরিবর্তন সাধন করে সেই কমিটি দ্বারা সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ করা। বর্তমান যে কমিটি আছে, সেটা যাতে পরিবর্তন করে রাজনৈতিক দলের ঐক্যমতের প্রতিফলন ঘটে। আমরা এই বিষয় সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করবো।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব পালন করা আলী রীয়াজ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে আলোচনার কথা তুলে ধরে বলেন, “বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অভিন্ন মত পোষণ করে। তাদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট ঐক্যমত্য আছে। এর গঠন, কাঠামোগত বিষয় ও সরকার কতদিন থাকবে তা নিয়ে আলোচনা করেছি। আলোচনায় বিভিন্ন রকম মতামত এসেছে। সময়সীমা বিষয়ে দুটি সুপারিশ ছিল। সংবিধান সংস্কার কমিশন থেকে ছিল ৯০ দিনের আর নির্বাচন কমিশন বলেছিল ১২০ দিন। সময় ও পরিধি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কোন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ হবে তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
আলোচনার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো অনেক কাছাকাছি এসেছে তুলে ধরে তিনি বলেন, এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে যে আলোচনা হয়েছে, তা অত্যন্ত ইতিবাচক। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘদিন যাবত আমরা সবাই অনেক সংগ্রাম করেছি। আমরা আশা করি, এ সকল বিষয় নিয়ে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারবো।
জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের গড়া নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ইতোমধ্যে জুলাই সনদ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘প্রতিশ্রুতি’ রক্ষা করতে না পারার অভিযোগ এনেছে।দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, কোনো একটি পক্ষ যদি দলীয় স্বার্থে ঐকমত্য প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে তাহলে সরকারের উচিত ভয় না করে অন্য সকল পক্ষ ও সাধারণ জনগণকে সাথে নিয়ে এ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করা।
বুধবার বৈঠকের সূচনা বক্তব্যেও আলী রীয়াজ জুলাই সনদ নিয়ে কথা বলেছেন।কমিশনের সহসভাপতি জুলাই সনদ নিয়ে আশার পাশাপাশি হতাশা থাকলেও জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে ‘একটা সনদের জায়গায়’ পৌঁছানো সম্ভব হতে পারে বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, কখনো কখনো আমরা অগ্রসর হই। কখনো কখনো আমরা যতটা অগ্রসর হতে চাই, ততটা না পারায় খানিকটা হতাশ হই। কিন্তু তারা পরেও আমরা চেষ্টা করলে জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে হয়ত একটা সনদের জায়গায় যেতে পারব। এটা আপনাদের সকলের প্রচেষ্টা, সকলের আন্তরিক সহযোগিতাটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় জিনিস।
জুলাই সনদ হবে রাজনৈতিক দলগুলোর এক ধরনের অঙ্গীকারনামা যেখানে ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট, অভ্যুত্থান পরবর্তী জনআকাঙ্ক্ষার বয়ান থাকবে এবং সে অনুযায়ী রাষ্ট্র সংস্কারের যেসব বিষয়ে একমত্য হবে, ত এগিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেবে রাজনৈতিক দলগুলো।রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত অক্টোবরে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিনের প্রতিবেদন জমা পড়ে ফেব্রুয়ারি মাসে। এসব প্রতিবেদনের সুপারিশের বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন এবং জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের মতামত চাওয়া হয়। যাদের মধ্যে ৩৩টি দল মতামত জানায়।এরপর ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত তাদের সঙ্গে ৪৫টি অধিবেশনের মাধ্যমে প্রথম পর্বের সংলাপ সম্পন্ন করে ঐকমত্য কমিশন।