৮ উপদেষ্টার দুর্নীতি-কে টানবে লাগাম-প্রশ্ন নগরবাসির

ব্যতিক্রম শুধু এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম-তিনি ইতিপূর্বে ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে দাবি করেন, উপদেষ্টা পদে যোগদানের আগে তার কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল না। ফেসবুকে প্রেস সচিবের সম্পদের হিসাব- আমার এক শ্যালকের কাছ থেকে ময়মনসিংহে একটি ফ্ল্যাট কিনেছিলাম। খুব সস্তায় পেয়েছিলাম সেটি। একই ভবনে আমার স্ত্রী তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে একটি ফ্ল্যাট পেয়েছেন। এই দুটি ফ্ল্যাট আমাদের জন্য মাসিক আয়ের একটি উৎস। এছাড়া গ্রামে আমার ৪০ শতাংশ আবাদি জমি আছে।
শফিক রহমান : সরকারের দুর্নীতিগ্রস্থ ৮ উপদেষ্টার গোমরফাঁস করায় তোলপাড় চলছে সরকারের ওপর মহলসহ সারাদেশে। বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে এই দুর্নীতিবাজদের লাগাম কে টানবে? নাকি এর কোনো সুরাহা হবে না? দেশের বিজ্ঞ মহলের মতে এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর সব উপদেষ্টা তাদের সম্পদের হিসাব দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এই এক বছরেও উপদেষ্টারা তাদের সম্পদের হিসাব দেননি।
এনিয়ে রাজনীতিকরা প্রকাশ্যে গনমাধ্যমে বক্তব্য দিলেও কোনো উপদেষ্টা এর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা এবং সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের আয় ও সম্পদ বিবরণী জমা দিতে নীতিমালা জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।০১ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা এবং সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা, ২০২৪’ জারি করা হয়েছে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা এবং সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি, যারা সরকার অথবা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত, তারা প্রতি বছর আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার সর্বশেষ তারিখের পরবর্তী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে সংযুক্ত ছকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী জমা দেবেন। তাদের স্ত্রী-স্বামীর পৃথক আয় থাকলে অনুরূপ আয় ও সম্পদ বিবরণীও প্রধান উপদেষ্টার কাছে একইসঙ্গে জমা দিতে হবে। এ আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রধান উপদেষ্টা স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত পদ্ধতিতে প্রকাশ করবেন বলেও নীতিমালায় বলা হয়।
৮ উপদেষ্টার সীমাহীন দুর্নীতি-
অন্তর্বর্তী সরকারের আটজন উপদেষ্টার ‘সীমাহীন দুর্নীতি’র প্রমাণ নিজের কাছে রয়েছে বলে দাবি করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তার। অবসরপ্রাপ্ত এই সচিব বলেছেন, এই উপদেষ্টাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ হয় না, বদলিও হয় না। শুক্রবার রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে এক সেমিনারে এ অভিযোগ করেন আব্দুস সাত্তার। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৮২ ব্যাচের এই কর্মকর্তা বর্তমানে অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের সভাপতি।‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ও আগামী দিনের জনপ্রশাসন’ শীর্ষক সেমিনারটি আয়োজন করে প্রশাসন ক্যাডারদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। সেখানেই তিনি ৮ উপদেষ্টার সীমাহীন দুর্নীতি ফাঁস করেন।
আব্দুস সাত্তার তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘আমি খুবই হতাশ। আমলাদের চরিত্র না হয় খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের রক্তের ওপর দিয়ে চেয়ারে বসা অন্তত আটজন উপদেষ্টার সীমাহীন দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ দিতে পারব। গোয়েন্দা সংস্থার কাছে আট উপদেষ্টার দুর্নীতির প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না’। তিনি বলেন, কষ্ট লাগে একজন উপদেষ্টার এপিএসের অ্যাকাউন্টে ২০০ কোটি টাকা পাওয়া গেলেও তাঁর বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। তিনি প্রশ্ন করেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতো একটি মন্ত্রণালয় নূরজাহান বেগম চালাতে পারেন? স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের মতো দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় একজন অনভিজ্ঞ উপদেষ্টা দিয়ে চালানো ঠিক হচ্ছে?ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত এক বছরে দুর্নীতি না কমে বরং অতীতের চেয়ে বেড়েছে বলে মন্তব্য করেন আব্দুস সাত্তার। তিনি বলেন, এক সহকারী কমিশনার (ভূমি) একটি স্কুলের জমির নামজারিতে ৩০ লাখ টাকা চেয়েছেন। ঢাকার আশপাশের একজন ইউএনও একটি কারখানার লে আউট পাশ করতে ২০ লাখ টাকা চেয়েছেন।
ব্যতিক্রম শুধু এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম-
তিনি ইতিপূর্বে ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে দাবি করেন, উপদেষ্টা পদে যোগদানের আগে তার কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল না।তিনি লেখেন, ‘‘২১ আগস্ট উপদেষ্টা পদে দায়িত্ব পালনের জন্য সম্মানী গ্রহণের লক্ষ্যে সরকারিভাবে সোনালী ব্যাংকে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলি। উক্ত অ্যাকাউন্টে ২১ আগস্ট-২০২৪ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি-২০২৫ পর্যন্ত লেনদেনের হিসাব জনগণের কাছে উপস্থাপন করছি।’’
সোনালী ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট ছাড়া অন্য আর কোনো অ্যাকাউন্ট নেই জানিয়ে সদ্য সাবেক এই উপদেষ্টা লেখেন, ‘‘উক্ত হিসাবে ১০ লাখ ৬ হাজার ৮৮৬ টাকা জমা হয়েছে। এ ছাড়া নয় লাখ ৯৬ হাজার ১৮১ টাকা উত্তোলিত হয়েছে।’’তিনি বর্ণনা করেন, ‘‘উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন, আমার বা আমার পরিবারের কোনো সদস্যের (স্ত্রী/মা/বাবা) নামে বাংলাদেশের কোথাও জমি বা ফ্ল্যাট নেই বা আমার বা আমার পরিবার কর্তৃক ক্রয় করা হয়নি।’’
এ ছাড়া তার একান্ত সচিবের ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ-এর হিসাবে ৩৬ হাজার ২৮ টাকা রয়েছে বলে জানান তিনি। নাহিদ ইসলামের একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনিও নিজের নামে বা উনার পরিবারের (স্ত্রী/মা/বাবা) কারো নামে বাংলাদেশের কোথাও কোনো সম্পত্তি ক্রয় করেননি- এমনটাও ফেসবুক পোস্টে নিশ্চিত করা হয়। যদি কেউ এই তথ্য যাচাই করতে চান, তাহলে ‘তথ্য অধিকার আইন-২০০৯’ অনুযায়ী বাংলাদেশের যে কোনো সরকারি দপ্তরে সেটা সম্ভব বলে উল্লেখ করেন নাহিদ ইসলাম।
ফেসবুকে প্রেস সচিবের সম্পদের হিসাব-
ওদিকে সরকারের প্রেস সচিব শফিকুল আলম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে তার সম্পদের হিসাব দিয়েছেন। ওই স্ট্যাটাসে তিনি উল্লেখ করেন, আমাদের এলাকার মসজিদের ভিক্ষুকরাও আমাকে চেনেন। কিছুদিন আগে কয়েকজন তরুণ আমাকে তাদের আড্ডার সামনে দিয়ে হাঁটার সময় ‘গণশত্রু’ বলে ডেকেছিল। এছাড়া তিনি আরও লেখেন, প্রায় পাঁচ বছর আগে আমি আমার এক শ্যালকের কাছ থেকে ময়মনসিংহে একটি ফ্ল্যাট কিনেছিলাম। খুব সস্তায় পেয়েছিলাম সেটি। একই ভবনে আমার স্ত্রী তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে একটি ফ্ল্যাট পেয়েছেন। এই দুটি ফ্ল্যাট আমাদের জন্য মাসিক আয়ের একটি উৎস। এছাড়া গ্রামে আমার ৪০ শতাংশ আবাদি জমি আছে।
স্ট্যাটাসে কিছু নগদ অর্থের বিবরণ দিয়েছেন শফিকুল আলম। তিনি লেখেন, আমার একটি মাত্র ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে যেখানে ১ কোটি ১৪ লাখ টাকা (১১.৪ মিলিয়ন টাকা) সঞ্চিত আছে। এই আগস্টে আমি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপিতে দুই দশকের চাকরি ছেড়েছি। অ্যাকাউন্টে থাকা অর্থের বেশিরভাগই আমার এএফপির চাকরির পেনশন এবং গ্র্যাচুইটির। কিছু মানুষ আমার কাছ থেকে প্রায় ৩০ লাখ টাকা ধার নিয়েছে। আমার ধারণা, বছরের শেষে আমার সঞ্চয় হয় অপরিবর্তিত থাকবে, নয়তো খরচের কারণে কমে যাবে। আমার একটি গাড়ি আছে। ঢাকা শহরে একটি গাড়ি পরিচালনা এবং ড্রাইভার রাখার মাসিক খরচ প্রায় ৫০ হাজার টাকা।
নামে-বেনামে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া-
১৯৭৯ সালের বিধিমালায় বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারী ১৫ হাজার টাকার বেশি মূল্যের কোনো স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি ক্রয়, বিক্রয় বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করতে চাইলে বিভাগীয় প্রধান অথবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবকে জানাবেন এবং ঘটনার পূর্ণ বিবরণ, প্রদেয় বা প্রস্তাবিত মূল্য এবং বিক্রয় ভিন্ন অন্যভাবে নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া উল্লেখ করবেন। এরপর অনুমতি পেলে তিনি সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবেন (ধারা ১১)।
কিন্তু এই বিধানটিও যে মানা হচ্ছে না তার প্রমাণ সরকারি কর্মচারীদের নামে-বেনামে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া। এই বিধানটি প্রতিপালিত হলে সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি শামসুদ্দোহা, ডিআইজি মিজানুর রহমান, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুল, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমান, এনবিআরের প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালসহ আরও অনেকের বিরুদ্ধে বাড়ি, ফ্ল্যাট, রিসোর্ট, শত শত বিঘা জমির মালিক হওয়ার সুযোগ ছিল না।
কেননা, আইন মেনে যখনই তারা এইসব সম্পদ কেনার জন্য তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে ইচ্ছা পোষণ করতেন, তখনই প্রশ্ন উঠতো যে তারা এগুলো কার টাকায় কিনবেন? সেই টাকার উৎস কী? ফলে কোনো সম্পত্তি কেনার আগেই তাদেরকে জবাবদিহির মধ্যে আসতে হতো।যেহেতু তারা বিধিমালার কোনো তোয়াক্কা করেননি, ফলে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হতে পেরেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানেও যার সত্যতা মিলেছে।