খনি থেকে সময় মতো কয়লা না তোলায় বন্ধের শঙ্কা বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র
দিনাজপুর প্রতিনিধি : খনি থেকে সময় মতো কয়লা না তোলায় বন্ধের শঙ্কা দেখা দিয়েছে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। এটি বন্ধ হলে উত্তরাঞ্চলের বিদ্যুত ব্যবস্থায় ধ্বস নামবে বলে শংকা করছে সংশ্লিষ্ঠরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের মে মাস থেকে বন্ধ রয়েছে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় কয়লা উত্তোলন। এর পর থেকে খনি থেকে নতুন করে আর কোনো কয়লা উত্তোলন হয়নি। যন্ত্রপাতি হস্তান্তরজনিত কারণে আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে নতুন কূপ থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু করার কথা জানিয়েছিল চীনা কোম্পানি সিএমসি-এক্সএমসি।
এদিকে দ্রুত কয়লার মজুদ ফুরিয়ে আসায় বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যে কারণে আগস্টের মাঝামাঝি নয়, প্রথম সপ্তাহ থেকে কয়লা উত্তোলনে যেতে চায় বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএমসিএল)।কয়লা উত্তোলনের বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে চীনা কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করেছে সংস্থাটি। সেখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের শঙ্কার বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
একই সঙ্গে সময় এগিয়ে নিয়ে এসে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে কয়লা উত্তোলনের কাজ শুরু করার পরিকল্পনা করা হয়। বিসিএমসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. সাইফুল ইসলাম সরকার বলেন, কয়লার মজুদ দ্রুত ফুরিয়ে আসায় আমরা চীনা কোম্পানিটির সঙ্গে আলোচনা করেছি। তারা আগস্টের প্রথম সপ্তাহে কয়লা উত্তোলনের কাজ শুরু করবে। আশা করছি আগস্টের প্রথম সপ্তাহে কয়লা উত্তোলন শুরু করা যাবে। এরই মধ্যে যন্ত্রপাতি স্থানান্তরের কাজ শেষ হয়েছে।
এদিকে এমন সময় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের শঙ্কা তৈরি হলো যখন বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখা ব্যাপকভাবে প্রয়োজন। একই সঙ্গে উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিকল্প সক্ষমতার কোনো কেন্দ্র গড়ে তোলা যায়নি। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ১ মে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ১৩১০ নম্বর কূপে কয়লার মজুদ শেষ হয়ে যায়। পরে ১৩০৬ নম্বর কূপে উত্তোলনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু একটি কূপ থেকে কয়লা উত্তোলন শেষ হলে নতুন খনিতে যন্ত্রপাতি স্থাপন করতে হয়। কাজটি করছে চীনা কোম্পানিটি।
আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিসিএমসিএলের কাছ থেকে সময় নিয়েছিল।কিন্তু বর্তমান বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু রাখা খুবই জরুরি। আর সেটি করতে হলে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদা মোতাবেক কয়লা সরবরাহ করলে অতিদ্রুতই এ কয়লা শেষ হয়ে আসবে।বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বর্তমানে দৈনিক ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে দৈনিক দুই হাজার টন কয়লা প্রয়োজন পড়ছে কেন্দ্রটির। ৫২৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা মজুদ শেষ হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ উৎপাদনও কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
এদিকে বর্তমানে খনির ইয়ার্ডে উত্তোলিত কয়লার মজুদ ২০-২৫ হাজার টনে নেমে এসেছে। যে পরিমাণ কয়লার মজুদ রয়েছে তা দিয়ে আর মাত্র ১০-১২ দিন বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালানো যাবে। এরপর কয়লা উত্তোলন করা না গেলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে।বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উত্তোলিত কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে ২০০৬ সালে তত্কালীন সরকার কয়লা খনির পাশেই কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করে। সে সময় ১২৫ মেগাওয়াট করে দুটি ইউনিটে মোট ২৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়। কিন্তু দেশে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে সেখানে আরো ২৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তৃতীয় ইউনিটের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ওই ইউনিটেও বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনা করছে। বর্তমানে ওই কেন্দ্রের শুধু তৃতীয় ইউনিটই চালু রয়েছে। আর তৃতীয় ইউনিটটি পুরোদমে চালাতে প্রতিদিন ৫ হাজার ২০০ টন কয়লার প্রয়োজন হয়। কিন্তু কয়লার মজুদ শেষ হয়ে যাওয়ায় বিপিডিবি ৫২৫ মেগাওয়াটের বিপরীতে উৎপাদন ২০০ মেগাওয়াটে নামিয়ে আনে। ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রতিদিন দুই হাজার টন করে কয়লা ব্যবহার করা হচ্ছে।
কিন্তু দেশে লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২০০ মেগাওয়াট থেকে উৎপাদন বাড়িয়ে ২৭৫ মেগাওয়াট উৎপাদন শুরু হয়। এতে প্রতিদিন ২ হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার টন কয়লা ব্যবহার করা হচ্ছে। এ অবস্থায় ইয়ার্ডে মজুদ থাকা কয়লা দিয়ে আর মাত্র ১০ দিনের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। আর ৫২৫ মেগাওয়াটের তিনটি ইউনিট পুরোদমে চালু করলে মজুদ কয়লা দিয়ে সর্বোচ্চ এক সপ্তাহ চলতে পারবে কেন্দ্রটি।
বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের এক কর্মকর্তা বলেন, কয়লা সংকটের কারণে বর্তমানে আমরা খুব খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেকটাই কমিয়ে আনা হয়েছে। বর্তমানে একটি ইউনিট চালু রেখে প্রতিদিন ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। কিন্তু যে পরিমাণ কয়লা আমাদের কাছে রয়েছে চলতি মাস শেষ হওয়ার আগেই তা শেষ হয়ে যেতে পারে।
এদিকে বিদ্যুত্সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হলে উত্তরাঞ্চল ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকটে পড়বে। কারণে এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে হলে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালাতেই হবে। এছাড়া নিজস্ব কয়লা উৎপাদনে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পটি এখনো সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। একই সঙ্গে উত্তরাঞ্চলে সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।