বাংলাদেশের উন্নয়ন এখন দক্ষিণ কোরিয়া বা সিঙ্গাপুরের সঙ্গে তুলনা
বদলে যাওয়া বাংলাদেশের খবর লন্ডন ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম ফিনান্সিয়াল টাইমসে
অর্থনৈতিক ডেস্ক রিপোর্টার : ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিলো ৫০০ ডলারের কম। তখন নারীদের গড়ে ৪.৫ জন সন্তান ছিলো। আর ৪৪ শতাংশ মানুষ চরম দারিদ্র্যতার মধ্যে বাস করতো। তবে এখন আর সেই বাংলাদেশ নেই। দেশটির মাথাপিছু জিডিপি বেড়েছে আটগুণ। গড়ে নারীদের এখন দুটি করে সন্তান। অর্থাৎ প্রতিটি সন্তানের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার জন্য বাবা-মায়ের কাছে পর্যাপ্ত অর্থ রয়েছে। ব্যাংকেও অর্থ রয়েছে। অতি দরিদ্রতায় রয়েছে মোট জনগণের অর্ধেক মানুষ। নারীদের অবস্থান বদলেছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা বেশি যাচ্ছে। ১৯৭১ সালে দেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন দেশে প্রতি পাঁচজনে একজন শিশু পাঁচ বছর বয়সের আগেই মারা যেত। যা এখন ৩০ জনে একজন।
বৃহস্পতিবার (২৮ জুলাই) লন্ডন ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম ফিনান্সিয়াল টাইমসের এক মন্তব্য প্রতিবেদনে এসব বলা হয়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন পত্রিকাটির আফ্রিকা বিষয়ক সম্পাদক ডেভিড পিলিং। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ এখনও দরিদ্র। দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, পরিবেশগত বিপর্যয়, দুর্নীতি রয়েছে। চলতি সপ্তাহে মোটা অংকের অর্থের জন্যে আইএমএফের কাছে যেতে হয়েছে দেশটিকে।
একসময় হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যা দিয়েছিলেন। এটা আফ্রিকার দেশের জন্যে হয়তো বলা যায়। তবে বাংলাদেশের উন্নয়নকে এখন দক্ষিণ কোরিয়া বা সিঙ্গাপুরের সঙ্গে তুলনা করা হয়। তবে অনেকে এখন বাংলাদেশকেই পথিকৃৎ হিসেবে দেখে। এমনকি তারা নিজেদের উন্নয়নের মধ্যে দিয়ে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশ ৯ মাসের যুদ্ধ শেষ করেই দুর্ভিক্ষ ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড দেখেছে। তবে সেখান থেকেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিস্ট স্টেফান ডারকন তিনটি কারণ দেখিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়। যার প্রথমটি হচ্ছে টেক্সটাইল শিল্প। বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালে ৩২ মিলিয়ন ডলার থেকে আজ ৩৪ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানি থেকে ৫৪ আফ্রিকান দেশের মিলিত তুলনায় দ্বিগুণ আয় করেছে। দ্বিতীয়টি হলো রেমিটেন্স। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিরা গত বছর ২২ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছে। তৃতীয়ত, ডেরকনের মতে, ব্র্যাক এবং গ্রামীণ ব্যাংকের মতো বেসরকারি সংস্থার ভূমিকা, যারা নিরাপত্তা বেষ্টনী প্রদান করে এবং কিছু দরিদ্র লোককে নিম্নস্তর থেকে তুলে আনে।
ডেরকন তার গ্যাম্বলিং অন ডেভেলপমেন্ট বইয়ে বলেন, সরকার একটি সঠিক পথ নিয়েছিল। উদাহরণে বলা যায়, দেশটি টেক্সটাইল শিল্পকে চালাতে দিয়েছে। এনজিওগুলোকে বিনা বাধায় কাজ করতে দিয়েছে। এটা সত্য যে বাংলাদেশ নিজের শ্রমকে সস্তা রেখেছে। এমনকি এজন্য বড় মূল্যও চোকাতে হয়েছে। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে ১ হাজারের বেশি পোশাক শ্রমিক নিহত হন।
রেনেসাঁ ক্যাপিটালের প্রধান অর্থনীতিবিদ চার্লি রবার্টসন দ্য টাইম ট্রাভেলিং ইকোনমিস্ট বইতে বলেন, বাংলাদেশের উন্নতির অন্যতম কারণ ৩টি। এরমধ্যে রয়েছে ৭০ ভাগ মানুষের সাক্ষরতা, দিনপ্রতি ৩০০ কিলোওয়াট ঘণ্টার উপরে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও শিশুদের উন্নয়ন। অনেক আফ্রিকান দেশে সাক্ষরতার হার ৭০ ভাগ। এর অর্থ তাদের তৈরি কারখানার কর্মীবাহিনী রয়েছে। কিন্তু সব দেশ প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে না। গিনিতে ২১ কিলোওয়াট, ইথিওপিয়া ৮২ কিলোওয়াট, ১৫০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ পায় জনগণ।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ সরবরাহের সঙ্গে পরিবারের আকার, পরিবারের সঞ্চয় ও শিল্পের জন্য ব্যাংক ঋণ পাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের জিডিপিতে ঋণের হার ৩৯ শতাংশ ও নাইজেরিয়ায় ১২ শতাংশের বিপরীতে। প্রজননের হারে নাইজেরিয়ার ৫.২ এর বিপরীতে বাংলাদেশের ২। ৩ এর নিচে উর্বরতার হারসহ আফ্রিকান দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বতসোয়ানা, মরিশাস, মরক্কো এবং দক্ষিণ আফ্রিকা। তারা মহাদেশের সবচেয়ে ধনী। আফ্রিকার বাকি অংশ মধ্যম আয়ের। কেনিয়ার প্রজননের হার ৩.৪।
১৯৭৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়া যেখানে ছিল, আজ বাংলাদেশ সেখানে। বেশ কয়েকটি আফ্রিকান দেশ রবার্টসনের লিফ্ট-অফের মানদণ্ড পূরণ করে বা প্রায় পূরণ করে। আর এই উন্নয়নের বড় নিয়ামক ভালো চিন্তার সরকার।