ডাক্তার থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়েছিলেন আল-জাওয়াহিরি
লাবণ্য চৌধুরী : ডাক্তার থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়েছিলেন আল-জাওয়াহিরি। একজন শল্য চিকিৎসক ছিলেন আল-জাওয়াহিরি। মিশরে ইসলামি জিহাদ নামে জঙ্গি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে আল-কায়েদার শীর্ষ নেতা ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গী হয় জাওয়াহিরি। লাদেন ২০১১ সালের মে মাসে মার্কিন বাহিনীর হাতে পাকিস্তানের এবোটাবাদে নিহত হওয়ার পর আল-জাওয়াহিরি আল-কায়েদার দায়িত্বগ্রহণ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের মোস্ট ওয়ান্টেডের তালিকায় ছিল তার নাম। তাকে ধরিয়ে দিতে যুক্তরাষ্ট্র ২ কোটি ৫০ লাখ ডলারের পুরস্কারও ঘোষণা করে। যা টাকার অঙ্কে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।
আফগানিস্তানে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হওয়ার খবর খবর টুইট করে জানিয়েছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হচ্ছে, গত রোববার আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ পরিচালিত ড্রোন হামলায় তিনি নিহত হন। আমেরিকা থেকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নিখুত টার্গেট করে জাওয়াহিরিকে হত্যা করে মার্কিন বাহিনী। ঘটনার সময় জাওয়াহিরি বাড়ির বেলকনিতে বসে ছিলেন। জাওয়াহিরি মোবাইল ফোন টার্গেট করে ড্রোন নিখুঁত নিশানায় নিশব্দ মিশাইল হামলায় খুন করে ডাক্তার থেকে শীর্ষ আল কায়েদা সন্ত্রাসী জাওয়াহিরিকে। মৃত্যু নিশ্চিত করে ড্রোন সেই চিত্র আমেরিকায় পাঠায়। ওই সময় জাওয়াহিরি ছাড়া আর কেউ নিহত হয়নি।
টুইট বার্তায় বাইডেন লিখেছেন, ‘যারা আমাদের ক্ষতি করতে চায়, তাদের থেকে আমেরিকার মানুষকে রক্ষা করার সঙ্কল্প ও ক্ষমতা প্রদর্শন জারি রেখেছে আমেরিকা।’ অন্য একটি টুইটে বাইডেন লেখেন, ‘ন্যায়বিচার দেওয়া গেল।’
আল কায়দা জঙ্গি দলে কীভাবে অভিষেক ঘটল জাওয়াহিরির? শল্য চিকিৎসক থেকে কী ভাবে বিশ্বের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ জঙ্গি তালিকায় নাম উঠল তাঁর? ১৯৫১ সালে মিশরের রাজধানী কায়রোয় এক বর্ধিষ্ণু পরিবারে জন্ম জাওয়াহিরির। ইসলাম ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ আল আজহারের প্রধান ইমামের পৌত্র ছিলেন তিনি।জাওয়াহিরির যখন ১৫ বছর বয়স, তখন প্রথম তিনি ইসলামি মৌলবাদ গ্রহণ করেন। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব মেডিসিনে পড়াশোনা করেছিলেন জাওয়াহিরির। পড়াশোনায় বরাবরই ভাল ছিলেন। ১৯৭৪ সালে স্নাতক হন তিনি। মিশরের সেনাবাহিনীতে শল্য চিকিৎসক হিসাবে তিন বছর কাজ করেছিলেন জওয়াহিরি। পরে মাদি এলাকায় নিজের ক্লিনিক খোলেন। ১৯৭৮ সালে শল্য চিকিৎসায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
১৯৮১ সালে জাওয়াহিরির সম্পর্কে প্রথম শিহরিত হয়েছিল বিশ্ব। মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার আল-সাদাতের হত্যা- পরবর্তী ঘটনায় যাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে ছিলেন জওয়াহিরি। তাঁর আইনজীবী দাবি করেছিলেন, সেই সময়ে জেলের মধ্যে জওয়াহিরির উপর নির্মম অত্যাচার চালানো হয়েছিল। এরপর থেকেই একের পর এক হামলার ঘটনায় নাম জড়ায় তাঁর। বেআইনি ভাবে অস্ত্র রাখার অভিযোগে তিন বছর জেল হয় জওয়াহিরির।
জাওয়াহিরির ছদ্মনাম ছিল ‘ডাক্তার’। মুক্তি পেয়ে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন তিনি। পাকিস্তানে তৎকালীন সোভিয়েত বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধরত আফগানিস্তানে জখম ইসলামি মুজাহিদিন গেরিলাদের চিকিৎসার জন্য ‘রেড ক্রিসেন্টে’র সঙ্গে কাজ করেছিলেন জাওয়াহিরি। ১৯৮৫ সালে হজ করতে সৌদি আরব পাড়ি দিয়েছিলেন জাওয়াহিরি। পরের বছর জেদ্দায় ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। পরবর্তী সময়ে লাদেনের ব্যক্তিগত উপদেষ্টা ও চিকিৎসক ছিলেন তিনি। মুসলিম ব্রাদারগুড সংগঠনের হাত ধরে আল কায়দায় যোগ দিয়েছিলেন জওহাহিরি।
১৯৯৩ সালে মিশরে ইসলামিক জিহাদের নেতৃত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন জাওয়াহিরি। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে সে দেশে সরকার ফেলে ইসলামিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করার কর্মসূচির পুরোধা ছিলেন তিনি। ১৯৯৫ সালের জুন মাসে প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। তার পরই ইসলামিক জেহাদিদের ধরপাকড় শুরু করেন মিশর কর্তৃপক্ষ। ১৯৯৯ সালে জাওয়াহিরিকে মৃত্যুদণ্ডের সাজার নির্দেশ দেয় মিশরের সামরিক আদালত। তবে তাঁকে ধরা যায়নি।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকায় জঙ্গি হামলায় লাদেনের পাশাপাশি অন্যতম চক্রী ছিলেন তিনি। এরপর বহু বছর পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্ত এলাকায় তিনি গা-ঢাকা দিয়েছিলেন বলে দাবি করেছিল বিভিন্ন মহল।২০১১ সালে আমেরিকার হানায় লাদেনের হত্যার পর আল কায়দার রাশ যায় জাওয়াহিরির হাতে। সে সময় থেকে আবারও চর্চায় উঠে আসে তাঁর নাম। লাদেনের হত্যার প্রতিশোধ নিতে পশ্চিমী দেশে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেন তিনি। তাঁর মাথার দাম ধরা হয়েছিল আড়াই কোটি ডলার।চার বার বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হন জাওয়াহিরি। তাঁর ছয় মেয়ে ও এক ছেলে। ২০০১ সালের ডিসেম্বরে আফগানিস্তানে আমেরিকার বিমানহানায় পুত্র মহম্মদ ও কন্যা আয়েশার মৃত্যু হয়।
‘হেলফায়ার’ ক্ষেপণাস্ত্র নিহত জাওয়াহিরি
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ অনেকদিন ধরেই আল-কায়েদার শীর্ষ এই নেতাকে খুঁজছিল বলে জানিয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। মার্কিন প্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেছেন, জাওয়াহিরি অনেক বছর ধরে লুকিয়ে ছিল এবং তাকে খুঁজে বের করে হত্যা করার ঘটনাটি কাউন্টার-টেররিজম ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ‘সতর্ক, ধৈর্য্যশীল এবং অবিচল’ কাজের ফল।
পরিচয় প্রকাশ না করে এক মার্কিন কর্মকর্তা কাবুলের ওই অভিযানের বিষয়ে বিস্তারিত অনেক তথ্য দিয়েছেন। তিনি জানান, বেশ কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র সরকার জাওয়াহিরি সমর্থিত একটি নেটওয়ার্ক সম্পর্কে অবগত ছিল এবং গত এক বছরে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর দেশটিতে আল-কায়েদার উপস্থিতির বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করছিলেন কর্মকর্তারা। চলতি বছর তারা শনাক্ত করেন, জাওয়াহিরির পরিবার কাবুলের একটি বাড়িতে আত্মগোপনে আছেন। পরে জাওয়াহিরিকেও একই স্থানে শনাক্ত করেন কর্মকর্তারা।
কয়েক মাস ধরে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আরও নিশ্চিত হন যে কাবুলের ওই গোপন আস্তানায় নিজের পরিবারের সঙ্গে আছেন জাওয়াহিরি। গত এপ্রিলের শুরুতে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে ব্রিফিং শুরু করেন তারা। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান পরে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে বিষয়টি অবহিত করেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘অভিযানের জন্য আমরা একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্যের ভিত্তিতে একটি প্যাটার্ন তৈরি করতে সক্ষম হই।’ কর্মকর্তারা বাড়িটির নির্মাণ-প্রকৃতি যাচাই-বাছাই করে নিশ্চিত করেন যে, বেসামরিক নাগরিকদের কিংবা জাওয়াহিরির পরিবারের ক্ষতি ছাড়াই অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন গোয়েন্দা তথ্য যাচাই করতে এবং মোক্ষম পদক্ষেপের জন্য প্রধান উপদেষ্টা ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন। গত ১ জুলাই সিআইএ পরিচালক উইলিয়াম বার্নস ও মন্ত্রিসভার সদস্যরা একটি প্রস্তাবিত অভিযান সম্পর্কে বাইডেনকে ব্রিফ করেন। গত ২৫ জুলাই প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ও উপদেষ্টাদের একটি চূড়ান্ত ব্রিফিং গ্রহণ করেন।
জাওয়াহিরিকে হত্যায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তালেবানের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ককে কীভাবে প্রভাবিত করবে তা নিয়ে আলোচনা করার জন্য ডাকেন। আলোচনায় অন্যদের কাছ থেকে মতামত চাওয়ার পর বেসামরিক হতাহতের ঝুঁকি কম থাকবে- এমন শর্তে একটি সুনির্দিষ্ট বিমান হামলার অনুমোদন প্রদান করেন বাইডেন। শেষ পর্যন্ত গত ৩০ জুলাই স্থানীয় সময় ৬টা ১৮ মিনিটে ড্রোন হামলা চালানো হয়। তথাকথিত ‘হেলফায়ার’ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে এই অভিযান সম্পন্ন করা হয়। জাওয়াহিরি বাড়ির ব্যালকনিতে বসে থাকা অবস্থায় ড্রোন হামলা হয়। এতে জাওয়াহিরি ছাড়া আর কারও প্রাণহানি হয়নি।