৮ বিভাগের খবরজাতীয়

পীরগঞ্জের কয়লা তুলতে রহস্যজনক গড়িমশি-প্রকল্প ১৬ বছর ফাইল বন্দি

বিশেষ প্রতিনিধি : জ্বলানি সংকটের এই মুহূর্তে রংপুরের পীরগঞ্জের কয়লা খনি আশার আলো হিসেবে দেখা দিলেও তা
তুলতে রহস্যজনক গড়িমশি চলছে দেড় যুগ ধরে। প্রকল্পটির সকল সমীক্ষা যাচাই হলেও ১৬ বছর ফাইল বন্দি পড়ে আছে মন্ত্রণালয়ে।রংপুরের পীরগঞ্জে মদনখালি কয়লাখনি আবিষ্কার হওয়ার পর ১৬ বছর পরও উত্তোলন করার্যক্রম শুরু করা হচ্ছেনা।

সংশ্লিষ্ঠরা জানিয়েছেন, জানা গেছে, এই খনি থেকে প্রতি বছর ৪ মিলিয়ন টন করে কয়লা উত্তোলন করা যাবে। কর্মসংস্থান হবে ১০ হাজার মানুষের। এশিয়ার সবথেকে উন্নত কয়লা যেখানে রয়েছে, পীরগঞ্জের সেই মদনখালি কয়লাখনি থেকে উত্তোলনের উদ্যোগ ঝুলে আছে ২০০৬ সাল থেকে।খালাশপীর কয়লাখনি থেকে উত্তোলন কার্যক্রম শুরু হলে কয়লাভিত্তিক ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। এখানকার কয়লা দিয়ে দেশের ৫০ বছরের চাহিদা পূরণ হবে। পাশাপাশি বাড়তি কয়লা রফতানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যাবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

হোসাফের জমা দেওয়া প্রতিবেদনটি মূল্যায়ন করার জন্য পেট্রোবাংলার হাইড্রোকার্বন ইউনিটের মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল মাইনিং কনসালটেড লিমিটেড (আইএমসিএল) নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সংস্থাটি মূল্যায়ন কাজ শেষ করে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে সরকারকে জমা দেয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূগর্ভস্থ খনন পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হলে প্রতি বছর ২ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব। প্রতি বছরের টার্গেটে উত্তোলন করা যাবে ৪ মিলিয়ন টন কয়লা। এর জন্য বিনিয়োগ হতে পারে ২০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার। প্রতি টন কয়লা বিক্রি হতে পারে বর্তমান বাজারের ইউএস ডলারে। এ কয়লাখনির কয়লা জ্বালিয়ে প্রথম ৫ বছর প্রতিদিন ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এবং কয়লা উৎপাদন বাড়ালে দশম বছরে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।

কয়লাখনি প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী সামছুদ্দিন বলেন, খনির সব কাজ শেষে কয়লা উত্তোলন পলিসি কমিটি গঠন করা হয়। মন্ত্রণালয় থেকে সরেজমিনে এসেছিলেন। এরপর আর অগ্রগতি নেই। মন্ত্রণালয়ে ফাইল পড়ে আছে। ১৯৮৯-১৯৯০ পর্যন্ত ভূতাত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি) পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পীরগঞ্জের মদনখালি ইউনিয়নের মাগুড়া গ্রামে এই খনির সন্ধান পায়। উপজেলার ১০ গ্রামের ২৫ বর্গকিলোমিটার এলাকায় টপোগ্রাফিক্যাল সার্ভে করে ১২ দশমিক ২৫ বর্গকিলোমিটার এলাকায় খনির সন্ধান পায় সংস্থাটি। চারটি কূপ খনন করে তাতে ৮ স্তরের এই খনিতে ২২২ মিটার থেকে শুরু করে ৬০৭ মিটার গভীরতায় কয়লা পাওয়া যায়। গড়ে ২৬৫ মিটার থেকে শুরু হয়ে ৩৮৭ মিটারে কয়লার স্তর শেষ হয়েছে। এখানে কয়লা মজুত আছে ৪৫১ মিলিয়ন টন। তার মধ্যে প্রমাণিত মজুত ২৭৭ মিলিয়ন টন এবং অতিরিক্ত আরও ১৭৫ মিলিয়ন টন মজুতের সম্ভাবনা ধরা হয়েছে। ২০০৩ সালে টপোগ্রাফিক্যাল সার্ভের জন্য কনসোর্টিয়াম অফ হোসাফ ইন্টারন্যাশনাল ও চায়নার সেনউইন মাইনিং গ্রুপ সরকারের কাছে আবেদন করে। ২০০৪ সালে সরকার অনুমোদন দিলে ২০০৫ সালে জরিপের কাজ শুরু করে।

কয়লাখনির একজন ভূ-তত্ববিদ নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, খনিজ জরিপের প্রাথমিক কাজে দ্বি-মাত্রিক ও ত্রি-মাত্রিক সিসমিক সার্ভের জন্য বোরিং করে সুড়ঙ্গপথে খনিতে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার এক্সপ্লোসিভ বিস্ফোরণ করা হয়। এতে কয়লার মজুত, পুরুত্ব, গভীরতা, চ্যুতি, কয়লার বিস্তৃৃতি ও স্তর সম্পর্কে পরীক্ষা চালানো হয়। সমীক্ষার পর এই খনিতে বিটুমিনাস গোত্রের কয়লার অবস্থান নির্ণয় করা হয়েছে, যার দহন ক্ষমতা ১ হাজার ৫০০ ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (বিটিইউ)। কয়লার কোনো কোনো স্তরে ‘কোকিং কোল’ নামে এক ধরনের কয়লা রয়েছে, যা দিয়ে যে কোনো ধাতু গলানোর কাজ করা সম্ভব।

তিনি দাবি করেছেন, এখানে বিটুমিনাস নামের উচ্চ জ্বালানি ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লা রয়েছে। প্রতি পাউন্ড কয়লার জ্বালানি ক্ষমতা ১০ হাজার ৫০০ বিটিইউ। এতে ক্ষতিকর সালফারের উপস্থিতি এক ভাগেরও কম। খনির এক স্তরে ধাতু গলানোর কাজে ব্যবহৃত কোকিং কোল ও চুনাপাথর এবং কাচ বালি রয়েছে। এগুলো অনেক খনিতেই পাওয়া যায় না। সমীক্ষার পর আরও উন্নত ড্রিলিং করা হয়। এরপর কয়লা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়েছে। তাতে সর্বোচ্চ মান এবং কয়লার মজুত নির্ধারণ করা হয়। ২০০৬ সালের আগস্ট মাসে হোসাফ গ্রুপ কয়লাখনির সমীক্ষা প্রতিবেদন (ফিজিবিলিটি রিপোর্ট) সরকারের কাছে জমা দিয়ে মাইনিং লিজের জন্য আবেদন করে। তাতে খনিটি ভূগর্ভস্থ (আন্ডারগ্রাউন্ড মাইনিং) পদ্ধতিতে উত্তোলন করার কথা বলা হয়েছে।

হোসাফ ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়ামের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ভূ-তত্ত্ববিদ) অনুপ কুমার রায় বলেন, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জাতীয় কয়লানীতি প্রণয়ন কমিটির ১৫ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধিদল খালাশপীর কয়লাখনি পরিদর্শন করে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। এরপর তারা সন্তোষ প্রকাশ করে উত্তোলন প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের আশ্বাস দিয়েছিল।

পীরগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরত্বে মাগুরা গ্রামে ১৯৫৯ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় খনির অবস্থান নির্ণয় করা হয়। এর ৩০ বছর পর ১৯৮৯-১৯৯০ সালে জিএসবি ২৫ বর্গকিলোমিটার খনি এলাকায় প্রাথমিকভাবে ৪টি কূপ খনন করে ৩টিতে ২৮৪ মিটার থেকে ৪৮০ মিটার গভীরতায় উন্নতমানের বিটুমিনাস কয়লার সন্ধান পায়।

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোরশেদ হোসেন বলেছেন, পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি না করে কয়লা উত্তোলন করলে এই অঞ্চলের শিল্পায়নে তা সহায়ক হবে। উত্তোলনে সর্বাধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। রংপুরের এ খনির কয়লা উত্তোলন করা হলে দেশের অর্থনীতির চেহারাও পাল্টে যাবে। দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি ও মধ্যপাড়া কঠিন শিলা প্রকল্প ছাড়া উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য খনিজ সম্পদ উত্তোলনে কোনো উদ্যোগ ও কার্যক্রম দৃশ্যমান হচ্ছে না। আবিষ্কারের পর তা ঝুলে আছে। আমরা মনে করি, এই খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করা হলে বিদ্যুতের ঘাটতি মোকাবিলা করে দেশের জ্বালানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।

 

সংশ্লিষ্ট খবর

Leave a Reply

Back to top button