বিশেষ প্রতিনিধি : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কভিডকালীন জরুরি নিয়োগে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। অনুসন্ধানে জাল-জালিয়াতির প্রমাণ পেয়ে চারজনের বিরুদ্ধে গত ১৫ জুন মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলার এজাহারে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগে বড় ধরনের অর্থ লেনদেনের তথ্যও উঠে এসেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে ক্ষেত্র বিশেষ ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে জাল-জালিয়াতির আশ্রয় গ্রহণ করা হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ২ হাজার ৭৯৮টি পদে জনবল নিয়োগের বিপরীতে টাকার অংকে এই লুটপাট দাড়ায় প্রায় ৬ কোটি টাকার মতো।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ডা. শেখ মোহাম্মদ হাসান ইমাম, সাবেক উপপরিচালক (প্রশাসন) ডা. আ ফ ম আখতার হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. শওকত আলী ও খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক মো. হারুনুর রশিদকে আসামি করা হয়েছে মামলায়। কমিশনের উপপরিচালক মো. ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলাটি করেন।
দুদক সূত্রে জানা যায়, কভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় জরুরি প্রয়োজনে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, মেডিকেল টেকনেশিয়ান ও ক্যার্ডিওগ্রাফারের ২ হাজার ৭৯৮টি পদে জনবল নিয়োগের ২০২০ সালে ২০ জুন তিনটি আলাদা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। লিখিত পরীক্ষার জন্য লিথোকোড সম্বলিত খাতা প্রণয়নে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের চুক্তি হয়। চুক্তি মোতাবেক বিভাগীয় চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. শাওকাত আলী পরীক্ষার খাতা তৈরি (লিথোকোডসহ), কক্ষ ভিত্তিক খাতা প্যাকেট করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়োগ কমিটির কাছে পাঠান।
তিনটি পদের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ২০২০ সালের ১২, ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর। মেডিকেল টেকনিশিয়ান, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও কার্ডিওগ্রাফার পদে লিখিত পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা কেন্দ্র থেকে খাতা, লিথোকড়ের ছেঁড়া অংশ এবং প্রশ্ন বুঝে নিয়ে বাহক মারফত অধিদপ্তরের নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব উপপরিচালক আ খ ম আক্তার হোসেনের কাছে জমা দেন। সদস্য সচিব খাতা মূল্যায়নের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের চেয়ারম্যানের কাছে পাঠান। মেডিকেল টেকনিশিয়ান পদে লিখিত খাতা যায় খিলগাঁও সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক মো. হারুনুর রশিদের কাছে। লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর রাতে কতিপয় সিন্ডিকেট চক্র পুনরায় নতুন খাতায় উত্তর লিখে মো. হারুনুর রশিদ ও মো. শাওকত আলীর সহযোগিতায় অফিসিয়ালি সরবরাহকৃত কিছু কিছু উত্তরপত্র বর্তমানে থাকা উত্তরপত্র দ্বারা প্রতিস্থাপন করেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, মেডিকেল টেকনেশিয়ান ও টেকনোলজিস্ট পদে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ চার হাজার ৪৫৩টি খাতা, টেবুলেশন শিট ও অন্যান্য ডকুমেন্টস পরীক্ষান্তে দুই হাজার ৪১১টি উত্তরপত্রে একাধিক স্ট্যাপলিংয়ের ছিদ্র ও পেন্সিলে লেখা বিভিন্ন প্রকারের সংকেত দেয়া রয়েছে। এছাড়া চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ দুই হাজার ৫৫৪ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৮০০ জন পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্রে একাধিক স্ট্যাপলিংয়ের ছিদ্র ও পেন্সিলে লেখা বিভিন্ন প্রকারের সংকেতও লক্ষ্য করা গেছে। দুই হাজার ৪১১টি উত্তরপত্রে একাধিক স্ট্যাপলিংয়ের ছিদ্র ও পেন্সিলে লেখা বিভিন্ন প্রকারের সংকেত সংক্রান্ত চাকরিপ্রার্থীদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা কোনো সঠিক তথ্য দেননি।
দুদক এজাহারে আরো বলা হয়, গোপনীয় অনুসন্ধানে জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কর্মরত অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজসে চাকুরীপ্রার্থীদের কাছ হতে ক্ষেত্রবিশেষে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে জাল-জালিয়াতি করা হয়। পরস্পর যোগসাজসে অসৎ উদ্দেশ্যে অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ, জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে খাতা প্রণয়ন ও খাঁটি হিসেবে ব্যবহার এবং অপরাধমূলক অসদাচরণ করে অফিসিয়ালি সরবরাহকৃত উত্তরপত্র বর্তমানে থাকা উত্তরপত্র দ্বারা কোনো একপর্যায়ে প্রতিস্থাপিত করে দণ্ডবিধি ৪০৯/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/৪৭৭ (ক) ও ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ হওয়ায় মামলাটি দায়ের করেছে দুদক।