জাতীয়

দুদকের জালে জনতা ব্যাংকের সাবেক এমডি- সালাম আজাদের পেটে হাজার কোটি!

লাবণ্য চৌধুরী : আর পার পাচ্ছেন না জনতা ব্যাংকের সাবেক এমডি আব্দুস ছালাম আজাদ। তার বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে দুদক। নিজের আখের গোছাতে সব অপকর্ম করেছিলেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে তিনি দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ৩ থেকে ৪ হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হয়ে তা পাচার করেছেন দুবাইয়ে। দুর্নীতির মাধ্যমে আয় করা অর্থ বিদেশে অবস্থানরত ছেলে-মেয়েদের কাছে পাচার করেছেন। তার আয়কর নথি ঢাকার কর অঞ্চল-১৫-হলেও তিনি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ লুকানোর জন্য সিরাজগঞ্জে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন।
তদন্তে মিলেছে ছালাম আজাদ তার একনিষ্ঠ অনুসারী মরহুম ডিজিএম ইসমাইলকে এফটিডি পরিদর্শন বিভাগের প্রধান করে সেখান থেকে বিভিন্ন নথিপত্র গায়েব করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ মঞ্জুরিতে অনিয়মসহ বিভিন্ন জালিয়াতির প্রমাণ নষ্ট করে ফেলেছেন।

জানা গেছে, ১৯৮৩ সালে জনতা ব্যাংকে চাকরি শুরু করেন আব্দুস ছালাম আজাদ। তিনি যতগুলো শাখায় কাজ করেছেন, ততগুলোতেই বেশুমার দুর্নীতি করে নিজে লাভবান হয়েছেন এবং ব্যাংকের মারাত্মক ক্ষতি করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা হওয়া এমন অভিযোগকে আমলে নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি এবার অনুসন্ধান শুরু করেছে জনতা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুস ছালাম আজাদের বিরুদ্ধে।
এরই মধ্যে দুদকের উপপরিচালক মো. রফিকুজ্জামানকে টিম লিডার ও অপর উপপরিচালক মো. আহসান উদ্দিনকে সদস্য করে গঠন করা হয়েছে দুই সদস্যের অনুসন্ধান দল। দুদকে জমা হওয়া অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণ বিতরণে জালিয়াতি, ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ বিতরণ, অর্থ পাচার, প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন তদন্তে নাম বাদ রাখা, ক্ষমতার অপব্যবহার করে সহযোগীদের বিপুল সম্পদের মালিক বানানোসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ আনা হয়েছে।

দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মুহাম্মদ আরিফ সাদেক দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে জানিয়েছেন, আব্দুস ছালামের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়ার পর তা আমলে নিয়ে অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। গত ৩০ জুলাই অনুতদন্ত-১-এর উপপরিচালক নারগিস সুলতানা স্বাক্ষরিত চিঠিতে দুই সদস্যের অনুসন্ধান টিম গঠন করার কথা জানানো হয়েছে।দুদক থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে জনতা ব্যাংকের এমডি হিসেবে যোগ দেন আব্দুস ছালাম আজাদ। ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর ৩ বছরের জন্য পুনরায় নিয়োগ পান। তিনি অবসরে যান ২০২৩ সালের ২৯ এপ্রিল।

দুদকে অভিযোগ থেকে জানা গেছে, জনতা ব্যাংক একসময় ছিল সরকারি খাতের সেরা ব্যাংক। ভালো শিল্পোদ্যোক্তা ও বড় ব্যবসায়ীরা ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক। অথচ এখন এ ব্যাংকের বড় গ্রাহকদের মধ্যে রয়েছে দেশের অন্যতম শীর্ষ ঋণখেলাপি অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপ এবং প্রভাবশালী বেশকিছু ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী। শাখা ব্যবস্থাপক হিসেবে ব্যাংকিং নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে অ্যাননটেক্সকে বড় অঙ্কের ঋণ দিয়েছিলেন তিনি। ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ বিতরণের বিষয়ে আব্দুস ছালাম আজাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম খুঁজে পেলেও নানামুখী প্রভাবের কারণে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। উপরন্তু তার মেয়াদ এক দফা বাড়িয়ে ৬৫ বছর পর্যন্ত এমডি পদে থাকার সুযোগ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

অভিযোগের তথ্যমতে, জনতা ব্যাংকের কামাল আতাতুর্ক শাখা ছিল এজিএম শাখা। আব্দুস ছালামের পরিচিতি ছিল ওই সময়কার এমডি আমিনুর রহমানের ডানহাত হিসেবে। শাখাটিকে ডিজিএম শাখায় উন্নীত করে তিনি ওই শাখার ডিজিএম হিসেবে পদোন্নতি নিয়ে শাখাপ্রধানের দায়িত্ব নেন। একইভাবে জনতা ব্যাংক ভবন শাখাকেও জিএম শাখায় উন্নীত করে তিনি জিএম পদোন্নতি নিয়ে ওই শাখায় বসেন। অনেক সিনিয়র ডিজিএম এবং জিএম থাকার পরও আব্দুস ছালাম তখনকার এমডি আমিনুর রহমানকে তোষণ করে সর্বকনিষ্ঠ হওয়ার পরও এই শাখায় প্রথম জিএম হিসেবে যোগ দেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আব্দুস ছালাম জনতা ব্যাংকের গ্রাহক বিসমিল্লা গ্রুপের খাজা সোলাইমানের কাছ থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে ২০০ কোটি টাকা দামের একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি ‘ঘুষ’ হিসেবে নিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক তদন্ত প্রতিবেদনে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ থাকলেও কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে তিনি ওইসব রিপোর্টের কার্যকারিতা স্থগিত করে রাখেন। দুই দফায় এমডি ও সিইও করার জন্য বিসমিল্লাহ গ্রুপ তার পেছনে ১৪ কোটি টাকা ব্যয় করে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।

অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, আব্দুস ছালামের অন্যতম সহযোগী আমীর খসরু চাকরিরত থাকা অবস্থায় বেফুট ওয়্যারের অলিখিত নির্বাহী পরিচালক হন। তার নামে ব্যাংকের অনুমোদনহীন পাসপোর্ট রয়েছে। এমডির নেকদৃষ্টি থাকায় ১০-১২টি মামলায় জড়িত থাকলেও তার নামকাওয়াস্তে শাস্তি হয়। এমডির সহযোগিতায় আমীর খসরু বিপুল সম্পত্তির মালিক বনে যান।

এমডির প্রভাবে ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের ডিএমডি নাজির উদ্দিন আহমেদকে জনতা ব্যাংকের সকল ইন্স্যুরেন্স দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। তার কাছ থেকে অবৈধ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নেন আব্দুস ছালাম। তার সহযোগিতায় প্রধান কার্যালয় শাখার জিএম আব্দুল ওয়াদুদ ও ডিজিএম লিটন রায় চৌধুরী সস্ত্রীক সিঙ্গাপুর ও দুবাই সফর করে সেখানে এমডি ছালাম আজাদের অর্থ পাচারে সহযোগিতা করেন।

অভিযোগে আরও বলা হয়, ব্যাংকের প্রয়োজনের সময় বদলি, প্রাইস পোস্টিংসহ ক্ষমতার অপব্যবহার করে অধীনদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ আদায় করেন ছালাম আজাদ। ক্রেডিট কমিটিতে প্রকল্প পাস, সুদ মওকুফের নামে অবৈধভাবে মোটা অঙ্কের ঘুষ নেন তিনি। এ ছাড়া শৃঙ্খলা কমিটিতে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের শাস্তি লাঘবের নামে সহযোগীদের মাধ্যমে বিপুল টাকা হাতিয়ে নেন।

অভিযোগে বলা হয়, অ্যাননটেক্সের ঋণ বিতরণের সময় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ভবন শাখা ব্যবস্থাপক ছিলেন ছালাম আজাদ। এসব অনুমোদনের ক্ষেত্রে তিনি প্রত্যক্ষ সহায়তা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তথ্য গোপন করেন। তিনটি ভুয়া রপ্তানি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে এলসির অর্থছাড়ের অনুমোদন করেন। মূলধনি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত না হয়েই এ অর্থ ছাড় করা হয়। এলসির বিপরীতে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট সি ইন্টারন্যাশনালের কাছে হস্তান্তর করার এখতিয়ার ছিল না আব্দুস ছালামের। কিন্তু শাখা ম্যানেজার হিসেবে তিনি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অ্যাননটেক্সের ক্ষেত্রে আমদানির ঋণপত্রের মূল্য পরিশোধের অনুমতি দেন। এই অনুমোদনসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ব্যাংকের অর্থ গ্রাহককে বের করে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন ছালাম আজাদ। ভুয়া আমদানির নামে বের করে নেওয়া অর্থের পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এরপরও অবৈধ ইশারায় ধাপে ধাপে পদোন্নতিও বাগিয়ে নেন সালাম।

সংশ্লিষ্ট খবর

Back to top button