নানা ঘটনাপ্রবাহে আগস্ট মাস বাঙালির জাতীয় জীবনে কলঙ্কের দিকদর্পণ হয় বারবার ফিরে আসে। এটি জাতি হিসেবে বাঙালির জন্য সুখকর নয়। এই মাসের ১৫ তারিখে কিছু বিশ্বাসঘাতক বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নোবেলজয়ী পশ্চিম জার্মানির নেতা উইলি ব্রানডিট বলেছিলেন, ‘মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না।
যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে, তারা যেকোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।’ এটি মূলত আমাদের আত্মঘাতি জাতি হিসেবে বিশ্বে পরিচয় করে দিয়েছে। এই আগস্টের ১৭ তারিখ দেশজুড়ে জঙ্গিদের বোমা হামলা ও ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলা উইলি ব্রানডিটের অভিব্যক্তির প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়।
বাঙালির আত্মঘাতির স্বরূপ শুধু ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে কিংবা ১৫ আগস্ট নয়, ঘটনাপ্রবাহের প্রতিমূহূর্তে ঘটে চলেছে। নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গের এই আত্মঘাতি পথের যাত্রী বাঙালির ক্ষুদ্র প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা থেকে দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, রাজনীতি, অর্থনীতি, মানবিক মূল্যবোধ চর্চার যে আয়োজন লক্ষ্য করা যায়, সেটি বহুলাংশে মেকি বা অন্তঃসারশূন্য।
বরীন্দ্রনাথ যথার্থ বলেছেন, ‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না; ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না; আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিকস্, এবং নিজের বাক্চাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য।’ এই স্বজাত চরিত্রবোধের তাগাদা থেকে বাঙালি ক্ষণে ক্ষণে বীরের বেশে, ক্ষণে ক্ষণে ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। জাতি হিসেবে আমাদের সর্বনাশার মূল কারণ এখানেই নিহিত।
যে বাঙালির প্রতি অতল ভালোবাসায় বঙ্গবন্ধু নিজের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া, সুখ-আরাম-আয়েশকে বিসর্জন দিয়েছেন; পরিবারের দায়িত্বকে গৌণ করে দেখেছেন; বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য বছরের পর বছর জেল খেটেছেন; ফাঁসির রজ্জু গলায় পরতে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করেছেন; সেই আত্মঘাতি বাঙালিই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছে। বিশ্ব ইতিহাসে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস থাকলেও সপরিবারে হত্যার শিকারের ইতিহাস বিরল।
তাই বলতে হয়, এই হত্যাকাণ্ডে শুধু ব্যক্তি মুজিবই ক্ষত-বিক্ষত হননি, দিশেহারা হয়েছে বাঙালির প্রবাহমান জীবনধারা। তবে ষড়যন্ত্র ও নিষ্ঠুরতায় আদর্শের পরিসমাপ্তি ঘটে না। বরং প্রবলবেগে বিস্তৃত হয়। যা আমরা কবি রফিক আজাদের ভাষায় ব্যক্ত করতে পারি-এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে,/সিঁড়ি ভেঙ্গে রক্ত নেমে গেছে-/বত্রিশ নম্বর থেকে/সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে/অমল রক্তের ধারা বয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ! পারস্পরিক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একটিতে আঘাত করলে অপরটিতে তার মারাত্মক অভিঘাত সৃষ্টি হবে, এটিই স্বাভাবিক। প্রতিক্রিয়াশীলচক্র বঙ্গবন্ধু ও তার আদর্শকে যতোই বিকৃতরূপে আঘাত করেছে বা করবার চেষ্টা করেছে, প্রতিবারই তাতে বঙ্গবন্ধু শক্তিশালী হয়ে ফিরে এসেছেন বাঙালির মন মননে।
তবে, একথা সত্য-প্রতিক্রিয়াশীলচক্রের অভিঘাতে বঙ্গবন্ধুর নীতি-দর্শন যতটা না ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে, তারচেয়ে ঢের বেশি ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে-যারা বঙ্গবন্ধুকে সিঁড়ি ডিঙ্গানোর হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করে জীবন ও রাষ্ট্রীয় আবহে চর্চা করে যাচ্ছেন। এদের জঘন্য কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন করে কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন-দেখ, একে একে সকলেই যাচ্ছে বি পথে অধঃপাত/মোহিনী নর্তকীর মতো/জুড়ে দিয়েছে বিবেক-ভোলানো নাচ মনীষার মিনারে,/বিশ্বস্ততা চোরা গর্ত খুঁড়ছে সুহৃদের জন্যে/সত্য খান খান হয়ে যাচ্ছে যখন তখন/কুমোরের ভাঙ্গা পাত্রের মতো,/চাটুকারদের ঠোঁটে অষ্টপ্রহর ছোটে কথার তুবড়ি,/দেখ, যে কোন ফসলের গাছ/সময়ে-অসময়ে ভরে উঠেছে শুধু মাকাল ফলে।/ঝলসে-যাওয়া ঘাসের মত শুকিয়ে যাচ্ছে মমতা/দেখ, এখানে আজ।
১৫ আগস্টকে ঘিরে যে ধরনের আড়ম্বরতা প্রত্যক্ষ করা যায়, সেই আড়ম্বরতায় সামান্যতম ত্যাগ যদি আমরা জাতীয় জীবনে চর্চা করতে পারতাম, সেটি হতো বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও নীতিদর্শনের প্রতি সুবিচার হতো। বঙ্গবন্ধু আজীবন অবহেলিত ও বঞ্চিত শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি কখনো আপোষ করেনি। কিন্তু বর্তমানে করপোরেট সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত রাজনীতি-সমাজনীতি ও জীবনধারায় আমরা বঙ্গবন্ধুর নীতিদর্শন ভুলে সময়ের গড্ডালিকা প্রবাহে নিজেদের সমার্পন করে দিয়েছি।
বাজার সিন্ডিকেশন কিংবা রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনকারীদের সঙ্গে আপোষ করে চলতে হচ্ছে আমাদের। বঙ্গবন্ধুর আত্মার মাগফেরাত কামনা করে ১৫ আগস্টের অনুষ্ঠানমালায় শোকাবহের চেয়ে ভোজনবিলাস, কোনো কোনো ক্ষেত্রে জনচলাচল পথ রুদ্ধ, হাসপাতালে জীবন মৃত্যু সন্ধিক্ষণে জীবনকাতুরে রোগীকে অতিষ্ঠ করে মাইক ব্যাবহার কিংবা নিজেদের মধ্যে কলহের দ্বন্দ্বে পরস্পর জড়িয়ে পড়ে জীবনহানির মতো ঘটনার সূত্রপাত করছে।
অন্যায্যভাবে চাঁদাবাজি করে প্রজন্মের নিকট বঙ্গবন্ধুর নীতিদর্শন ও স্বাধীনতার চেতনাকে হেয় প্রতিপন্ন করার উম্মাদনায় জড়িয়ে পড়ছে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ধারণ করে তার তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনা যখন একের পর এক বাঁধা-ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার পাশাপাশি বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, তখন এধরনের নীতিবিরোধী কার্যক্রম মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের জন্য শুভকর হচ্ছে না।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এবং বৈশ্বিক মন্দার কারণে জাতি এক ধরনের কঠিন সময় অতিক্রম করছে। এই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের নীতি-দর্শন থেকে বিচ্যুত হয়ে অপরাজনীতির আশ্রয় নিলে সেটি হলে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি ও বঙ্গবন্ধুর ঘাতকচক্রকে শক্তিশালী করা। ’৭৫ পূর্ববর্তী অতল দেশপ্রেম আর ত্যাগ-তিতিক্ষার পূজনীয় রাজনীতি কেন, কেমন করে নষ্ট আর অশ্লীল হলো? সেটি গভীরভাবে অনুধাবনে নিতে হবে।
ছাত্র রাজনীতিতে কেন ছাত্র ও জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা অনুপস্থিত, সেটি বিচার বিশ্লেষণের সময় এসেছে। ভোগবাদের বিত্তমহ ছাত্র, শ্রমিক, যুব রাজনীতিকে যেভাবে গ্রাস করছে, সেটি পরোক্ষভাবে বিরাজনীতিকে উস্কে দিচ্ছে। রাজনীতিবিদদের লোভ-লালসার হাত ধরে রাজনীতি দুর্বৃত্তায়নের যে ধারা চলমান, সেটি রাজনীতিতে টাকা এবং টাকাওয়ালাদের প্রভাব বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই চক্র যতোই শক্তিশালী হচ্ছে, জনদুর্ভোগ ততোই বেড়ে যাচ্ছে।
কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, উন্নয়ন, উৎপাদন সবকিছু যেভাবে করপোরেট মালিকদের হাতে জিম্মি হচ্ছে, সেটি জাতির জন্য অদূর ভবিষ্যতে সুফল বয়ে আনবে না। জাতীয় মননশীলতার জায়গাগুলো এখন করপোরেট মাফিয়াদের সিঁড়ি ডিঙ্গানোর হাতিয়ারে পরিণত। ফলে জাতীয় মননশীলতায় নোংরামি ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। এটি নতুন প্রজন্মের কাছে কোনো ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে না।
ফলে নবাগত প্রজন্ম বিভ্রান্ত হচ্ছে, পা বাড়াচ্ছে বিপদগামীতায়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, নীতি-দর্শন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চর্চার আড়ম্বরতায় দেশের বড় বড় করপোরেট মালিকদের আর্থিকখাত লুটপাট, অর্থপাচারের যে চিত্র আসছে, তার নেপথ্যে কারা কী কারণে জড়িয়ে ছিল, সেটির অনুসন্ধান সময়ের দাবি। শ্রমঘন কষ্টার্জিত রেমিট্যান্স জাতীয় অর্থনীতির ভিতকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে কেন পশ্চিমা দুনিয়ার অর্থনীতিকে গতিশীল করছে, কারা এসব করছে তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে শোকাবহ আগস্টের অন্যতম অঙ্গীকার।
রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ রাজনীতিবিদদের হাতে না থাকায় বাইরের লোক রাজনীতিতে এসে শুধু রাজনীতিকেই কলুষিত করেনি তারা যে পেশা থেকে এসেছেন, সেই পেশাকেও কলুষিত করছে নানান দুর্নীতির মাধ্যমে। একজন ব্যবসায়ী সরকারি দলে যোগ দিয়ে টাকার পাহাড় গড়ে ব্যবসায়ী সমাজে ‘অনুকরণীয়’ দৃষ্টান্ত হয়ে যাচ্ছেন। তাকে অনুসরণ করে অন্য ব্যবসায়ীরাও একই পথে হাঁটছেন। ফলে সর্বক্ষেত্রে দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির প্রচলন হয়েছে। এসব লুটেরা, দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদের অনেকেই টাকা দিয়ে পদ-পদবি কিনে নিচ্ছেন। রাজনীতিতে হাইব্রিডদের এখন রমরমা বাজার। রাজনীতির এমন দুর্বৃত্তায়ন চলতে পারে না।
মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতিকে সমুন্নত করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি, দর্শন ও চেতনাকে লালন করতে হবে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর ন্যায়বিচারের মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ রাষ্ট্র নির্মাণে কঠোর হতে হবে। দেশের রাষ্ট্রনায়ক জাতির পিতার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে তার উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেতাকর্মীদের ত্যাগের মানসিকতায় কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। এটিই প্রত্যাশিত।
দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির বিস্তার বহিঃশক্তিকে দেশের রাজনীতিতে নাক গলানোর সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এই অপরাজনীতি, দুর্বৃত্তায়ন, লুটপাট, অর্থপাচার মুক্ত রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তোলার পাশাপাশি সকল পেশায় পেশাজীবীদের পেশাদারিত্ব সৃষ্টি ও জবাবদিহিতে আনার জন্য একাত্তরের মতো ইস্পাত কঠিন ঐক্য ও সংহতি গড়ে তুলতে হবে।
মুজিবপ্রেমিক ত্যাগী রাজনীতিবিদ ও কর্মী সমর্থকদের ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার স্মার্ট উন্নত বাংলাদেশ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাবার শপথ নিতে হবে। তা না হলে রাষ্ট্র ও রাজনীতি গভীর থেকে গভীরতর অমানিশায় ডুবতে থাকবে। অতল সেই অন্ধকার থেকে বাংলা ও বাঙালি জাতিকে মুক্ত করা কঠিন হয়ে পড়বে।
যা আমাদের কারো কাম্য নয়। বঙ্গবন্ধু তার নোটবুকে লিখেছিলেন, একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে। আজ নানা কারণে বঙ্গবন্ধুর এই নীতি-দর্শন আমরা ভুলতে বসেছি।
সেই ভুল শুধরে আমাদের সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শপথ নিতে হবে। অন্যথায় আড়ম্বরতা থাকবে, মুক্তিচেতনা দর্শন আদর্শের বাড়ম্বরতা থাকবে, গণমুক্তি আমাদের থেকে যোজন যোজন দূরে সরে যাবে। সেই দায় থেকে আমরা কোনোভাবেই নিজেদের মুক্ত রাখতে পারবো না। ইতিহাসের কাঠগড়ায় নিষ্ঠুর বাস্তবতায় অনাগত প্রজন্মের সামনে দাঁড়াতে হবে। মো. শামসুর রহমান : সাধারণ সম্পাদক, আইডিইবি ও চেয়ারম্যান, ট্রাস্টিবোর্ড, এনপিআই ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।