শফিক রহমান : অবশেষে ডলার কারসাজিতে জড়িত ১৩ ব্যাংক কে ধরছে বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি)। এই ব্যাংকগুলো বেশি দামে ডলার বিক্রি করে শত শত কোটি টাকার ফায়দা লুটেছে। এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে ১৩ ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
একই সঙ্গে উচ্চমূল্যে মার্কিন ডলার বিক্রির জন্য ১৩টি ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যাও তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি)। তলব করা ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতের, যার মধ্যে একটি শরিয়াহ-ভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকও রয়েছে।সোমবার (৪ সেপ্টেম্বর) কেন্দ্রীয় ব্যাংক দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সূত্র বলেছে, রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) বিভিন্ন ব্যাংকে চিঠি পাঠিয়ে আগামী ৫ কার্যদিবসের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেসবাউল হক বলেন, বেশি দামে ডলার বিক্রির দায়ে ৭ মানি চেঞ্জারের ট্রেডিং লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে।
একই ধরনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আরও ১০ জন মানি চেঞ্জারের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর ওপরও নজরদারি করা হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি। আগস্টে সর্বোচ্চ আমদানি মূল্য ১০৯ দশমিক ৫ টাকা নির্ধারণ করা হলেও কিছু ব্যাংক ১১৭ টাকা পর্যন্ত ডলার বিক্রি করেছে। জানা গেছে, ডলারের লেনদেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি এবং কাস্টমার সার্ভিস এবং ফরেন এক্সচেঞ্জ পরিদর্শন বিভাগ পরিদর্শন করে। সম্প্রতি ডলারের দাম বাড়ায় পরিদর্শনে পাঠায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তথ্য সংগ্রহের পর ডলার বিক্রির বিষয়গুলো যাচাই করা হচ্ছে।
যাহোক, অতিরিক্ত মুনাফার কারণে ২০২১ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১২টি ব্যাংকের মুনাফা থেকে সিএসআর খাতে ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করার নির্দেশ দেয়। ওই তালিকায় বিদেশি মালিকানাধীন দুটি এবং বেসরকারি খাতের ১০টি ব্যাংক ছিল।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে।এ সংকট মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুরুতে ডলারের দাম নির্ধারণ করলেও সংকট অব্যাহত রয়েছে।
একই সঙ্গে ব্যাংকের সহায়তায় মতিঝিল দিলকুশায় ডলারের অবৈধ কারবার খতিয়ে দেখছে বিবি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মতিঝিল দিলকুশায় অবৈধ ডলার হুন্ডি বাণিজ্যের রাজত্ব চালাচ্ছে মন্টু ও বাশার বাহিনী। এরা একসময় দালাল থেকে এখন শত কোটিপতি বনেছে। এদের সঙ্গে মতিঝিল-দিলকুশার বিভিন্ন ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ সমূহের কর্তাদের গভীর দহরম মহরম রয়েছে। ব্যাংক শাখা ম্যানেজারদের সঙ্গেও রয়েছে ওঠাবাসা। যেগুলো তদন্ত করে ৬ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জের শাখা ম্যানেজারের কাছে কৈফিয়ত তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মন্টু’র নেতৃত্বে রয়েছে অর্ধ শতাধিক দালাল। যাদের মাধ্যমে ডলার ব্যবসা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে মন্টু। বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা জানায়, মন্টু মতিঝিল ও পল্টন এলাকার সব মানি এক্সচেঞ্জে বিদেশি মুদ্রা সরবরাহ করে আঙ্গুল ফুলে বটগাছে পরিণত হয়েছেন।
গড়ে তুলেছে কালোবাজারে একটি শক্তিশালী ডলার পাউন্ড ইউরো বিকিকিনি সিন্ডিকেট। এরমধ্যে মন্টু চক্রের সদস্য ওমর ফারুক নিহন মানি এক্সচেঞ্জে অর্থ সরবরাহ দিতে এসে ডলারসহ ধরা পড়ে গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের হাতে।
তখন জিজ্ঞাসাবাদে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, মন্টুর বাসা থেকে প্রতিদিন মানি এক্সচেঞ্জগুলোতে বিদেশি মুদ্রা সরবরাহ করা হয়। সন্ধ্যায় মন্টুর নয়া পল্টনের বাসায় সারাদিনের লেনদেন শেষে টাকা ও ডলার পৌঁছে দেওয়া হয়।
এদিকে একই চক্রের সক্রিয় সহযোগীরা ছড়িয়ে পড়েছে গুলশান বনানীতেও। গত বুধবার সকালে গুলশান-১-এর নাভানা টাওয়ারে সাব মানি এক্সচেঞ্জ ও লর্ডস মানি এক্সচেঞ্জ এবং গুলশান দুই-এর ল্যান্ডমার্ক টাওয়ারে মেট্রো মানি এক্সচেঞ্জে অভিযান চালায় এনএসআই ও বিএফআইইউ।
এদিকে বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে ৫ থেকে ৬ টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে ডলার। এমন অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় ৭টি মানি চেঞ্জারের ব্যবসার লাইসেন্স স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে বেশি দামে ডলার লেনদেন করায় আরও ১০ মানি চেঞ্জারের কাছে ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে। যদি সন্তোষজনক উত্তর না পাওয়া যায় তাদের বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ জানিয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক।
তিনি বলেন, কয়েকটি মানিচেঞ্জার দীর্ঘদিন ধরে নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি মূল্যে ডলার বিক্রি করছে। কিন্তু তারা বরাবরই বিষয়টি গোপন করে ভুল তথ্য দিয়ে যাচ্ছে। এমন তথ্যের প্রমাণ পাওয়ায় ৭টি মানি চেঞ্জারের ব্যবসার লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে বেশি দামে ডলার লেনদেন অভিযোগ ওঠায় আরও ১০ মানি চেঞ্জারের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।
লাইসেন্স স্থগিত করা মানিচেঞ্জার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—ইয়র্ক মানি এক্সচেঞ্জ, জামান মানি চেঞ্জিং হাউস, জেনি মানি এক্সচেঞ্জ লিমিটেড, স্ট্যান্ডার্ড মানি এক্সচেঞ্জ, মার্সি মানি এক্সচেঞ্জ, জেবি মানি এক্সচেঞ্জ ও বেঙ্গল মানি এক্সচেঞ্জ। অপরদিক ব্যাখ্যা তলব করা ১০ মানি চেঞ্জার হলো,
নিউ প্রাইম মানি চেঞ্জার, উত্তরা মানি চেঞ্জার, মিসা মানি এক্সচেঞ্জ, যমুনা মানি এক্সচেঞ্জ, পাইওনিয়ার মানি এক্সচেঞ্জ, বুড়িগঙ্গা মানি এক্সচেঞ্জ, স্কাফ মানি চেঞ্জার, হযরত খাজা বাবা মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্র, গ্লোরি মানি এক্সচেঞ্জ ও মাতৃক মানি চেঞ্জার। এছাড়া মতিঝিলের নিয়ন মানি চেঞ্জার এবং পল্টনের জনী ট্রেডার্সের বিষয়ে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
এদিকে বেশিরভাগ ব্যাংক ও মানি চেঞ্জারে ডলার মিলছে না। ফলে নগদ ডলারের দাম আবারও বেড়ে গেছে। রাজধানীতে খোলাবাজারে প্রতি ডলার ১১৭ থেকে ১১৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া নিয়ম অনুযায়ী, এখন নগদে প্রতি ডলারের দাম ১১২ টাকা ৫০ পয়সার মধ্যে থাকার কথা। কিন্তু চিকিৎসা, শিক্ষা বা ভ্রমণের জন্য যারা বিদেশে যাচ্ছেন তাদের প্রতি ডলার কিনতে নগদ খরচ করতে হচ্ছে ১১৮ টাকা পর্যন্ত।
মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব সেখ মো. হেলাল সিকদার বলেন, ডলারের চাহিদা বাড়ার সুযোগে কেউ বাজার অস্থির করার অপচেষ্টা চালাতে পারে। যারা নিয়ম না মেনে ব্যবসা করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। আর বাংলাদেশ ব্যাংক সেই কাজটি করছে। অতি মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে সৎ ব্যবসায়ীরা টিকতে পারবে না বলে দাবি করেন তিনি।
এদিকে রাজধানীর দৈনিক বাংলা মোড় ও গুলশানে চারটি মানি এক্সচেঞ্জে অভিযান চালিয়েছে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও বাংলাদেশ ফাইনান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট বিএফআইইউ।বুধবার (৩০ আগস্ট) দৈনিক বাংলা মোড়ে আরএস ভবনের দ্বিতীয় তলায় নিহন মানি এক্সচেঞ্জে অভিযান চালায় এনএসআই ও বিএফআইইউ চালায়।অভিযানে এক লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার (১ কোটি ৯০ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা), ৩০ হাজার কানাডিয়ান ডলারসহ (২৬ লাখ ৫৫ হাজার টাকা) আরও কিছু বিভিন্ন দেশের মুদ্রা ও টাকা পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, এনএসআই ও বিএফআইইউয়ের অভিযানে হুন্ডির ক্যারিয়ার মিরাজুল ইসলামের কাছ থেকে নগদ ৩৮ লাখ ১৮ হাজার টাকাও পাওয়া যায়। এই টাকা মানি এক্সচেঞ্জের মালিক শহীদের কাছে জমা দিতে এসেছিলেন মিরাজ। এ সময় তাকে তাকে হাতেনাতে ধরা হয়। এভাবে শহীদ হুন্ডির কারাবার চালিয়ে আসছিলেন বলে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন। মালয়েশিয়াতে বসবাস করা গোপাল এই অর্থের মূল হোতা বলেও জানান তারা।
সূত্র মতে, মন্টু নামে এক ব্যক্তি মতিঝিল ও পল্টন এলাকার সব মানি এক্সচেঞ্জে বিদেশি মুদ্রা সরবরাহ করার একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। মন্টুর চক্রের সদস্য ওমর ফারুক নিহন মানি এক্সচেঞ্জে অর্থ সরবরাহ দিতে এসে ডলারসহ আটক হন।জিজ্ঞাসাবাদে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, মন্টুর বাসা থেকে প্রতিদিন মানি এক্সচেঞ্জগুলোতে বিদেশি মুদ্রা সরবরাহ করা হয়। সন্ধ্যায় মন্টুর নয়া পল্টনের বাসায় সারাদিনের লেনদেন শেষে টাকা ও ডলার পৌঁছে দেওয়া হয়।
লর্ডস মানি এক্সচেঞ্জে নির্ধারিত মূল্যের বেশি দামে ডলার কেনা-বেচা এবং নিয়ম বহির্ভূতভাবে ডলার বিক্রির অনিয়ম পাওয়া যায়। পরবর্তীতে নিয়ম মেনে ব্যবসা পরিচালনার জন্য মালিকদের সতর্ক করে দিয়েছেন এনএসআই ও বিএফআইইউয়ের কর্মকর্তারা।অভিযানে নাভানা টাওয়ারের পেছনে শিহাব, মিরাজ, লিটন, তুষার, জিল্লুর, মিন্টু ও রাজিব নামে ব্যক্তিরা বিদেশি মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় করে বলে সন্ধান পেয়েছেন এনএসআই ও বিএফআইইউ কর্মকর্তারা।এদিকে মেট্রো মানি এক্সচেঞ্জে অভিযান চালিয়ে ১৫ থেকে ১৬ লাখ ছেড়া টাকা, অতিরিক্ত দামে ডলার বিক্রির অনিয়ম পেয়েছেন এনএসআই ও বিএফআইইউ।
ওদিকে, বিএফআইইউয়ের উদ্যোগে মতিঝিলের অনুমোদনহীন ওয়েলকাম মানি এক্সচেঞ্জে অভিযান চালিয়ে প্রাক এক কোটি টাকা সমমূল্যের দেশি-বিদেশি মুদ্রা উদ্ধার করা হয়েছে।অভিযানে বিভিন্ন নোটের মোট ৯৬ লাখ ৬৬ হাজার ৫৯০ টাকা জব্দ করা হয়। এ ছাড়া ৬ হাজার ৯০০ কানাডিয়ান ডলার, ৮৫৫ সৌদি রিয়াল, ৩৬১ ইউএস ডলার, ১০০ ইন্ডিয়ান রুপি, ১ কুয়েতি দিনার, ১০০ পয়সা ওমানি রিয়েল এবং বিভিন্ন দেশের কয়েন পাওয়া গেছে।