লাবণ্য চৌধুরী : এবার তৈরি পোশাকের স্যাম্পল রপ্তানির নামে পাচার হয়েছে ৮২১ কোটি টাকা। গার্মেন্টস রপ্তানি শিল্পে দেশের ইতিহাসে এত বড় টাকা পাচারের ঘটনা বিরল বলে জানিয়েছেন শুল্ক গোয়েন্দারা। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে জানিয়েছেন রপ্তানির আড়ালে ৩৩ গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান ৮২১ কোটি টাকা পাচার করে দিয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় অর্থপাচার কেলেঙ্কারির অন্যতম এই ঘটনা সম্প্রতি উদ্ঘাটন হলেও এসব পণ্য রপ্তানি হয়েছে ২০১৭ সাল থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠান ১৩ হাজার ৮১৭টি চালানে ৯৩৩ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে এনেছে মাত্র ১১১ কোটি টাকা। বাকি ৮২১ কোটি টাকা সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, কানাডাসহ ২৫টি দেশে পাচার করতে ভুয়া রপ্তানি নথি ব্যবহার করেছে প্রতারকচক্র।
সংস্থাটির তদন্ত নথি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব পণ্য রপ্তানি করতে পণ্যের প্রকৃত দামের চেয়ে অন্তত ১০ গুণ কম মূল্য দেখানোর পাশাপাশি রপ্তানি পণ্যকে ‘নমুনা’ পণ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে। নমুনা পণ্য হিসেবে দেখানোর কারণে এসব পণ্যের বিপরীতে দেশে কোনো টাকা প্রবেশের সুযোগ নেই। সংস্থাটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এসব অর্থ পাচারের সঙ্গে একাধিক চক্র জড়িত। আমরা দেশে-বিদেশে অনেক সুনামধন্য প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছি। খুব শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। রপ্তানি নথি অনুযায়ী, ঢাকাভিত্তিক বায়িং হাউস এশিয়া ট্রেডিং করপোরেশন ২০২২ সালে ৩০৮ কোটি টাকার (২৮ মিলিয়ন ডলার) মূল্যের ১৪ হাজার ৮৫ টন টি-শার্ট ও প্যান্ট সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াতে পাঠিয়েছে। তবে এই চালানের বিপরীতে একটি ডলারও দেশে আসেনি।
রপ্তানি নথিতে কোম্পানিটি ১ হাজার ৩৪২টি চালানের সবগুলোই ‘নমুনা পণ্য’ হিসেবে দেখিয়েছে। শুল্ক নিয়ম অনুযায়ী, নমুনা পণের কোনো রপ্তানি আয় দেশে আসে না। একইভাবে, গাজীপুরভিত্তিক রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান হংকং ফ্যাশন ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের মে মাসের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা ও মালয়েশিয়াসহ ৭টি দেশে ৪৩ দশমিক ২১ কোটি টাকা মূল্যের ১ হাজার ১৬০ টন পণ্য রপ্তানি করে। এর বিপরীতে মাত্র ১২ দশমিক ৭৩ কোটি টাকা ফেরত আনা হয়েছে। বাকি ৩০ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা পাচার হয়েছে বলে সংস্থাটির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
আমরা এর আগে এত বড় আকারের রপ্তানি জালিয়াতি শনাক্ত করিনি। অতীতে আমরা সর্বোচ্চ ১০ বা ১০টি চালান মানি লন্ডারিংয়ের তথ্য নিয়ে কাজ করেছি। একসঙ্গে এতগুলো চালান জড়িত থাকার অনিয়ম আমাদের নজরে আসেনি। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ৩৩টি প্রতিষ্ঠানের ১৩ হাজার ৮১৭টি চালানে অর্থ পাচারের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছি। এ সংখ্যা আরও বাড়বে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর (সিআইআইডি) চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে শুরু করে ৩ ধাপে ৬ মাসের তদন্তের পর এ জালিয়াতি উদঘাটন করেছে।
এসব অর্থ পাচারের নথি সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রাপ্ত নথি অনুসারে,পাচার হওয়া ৮২১ কোটি টাকার মধ্যে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা গেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে। বাকিগুলো কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, কাতার, স্পেন, কুয়েত, ফিলিপাইন, সুইডেন, রাশিয়া, পানামা, থাইল্যান্ড, জর্জিয়া এবং ফিলিস্তিন অঞ্চলসহ ২২টি দেশে পাঠানো হয়েছে।
শুল্ক গোয়েন্দা তদন্তে যে ৩৩টি রপ্তানিকারক ও বায়িং হাউসের নাম উঠে এসেছে তাদের অধিকাংশই ঢাকা ও গাজীপুরে অবস্থিত।
রপ্তানি নথিতে অন্তত ১২টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। তবে ব্যাংকের কর্মকর্তারা দাবি করে বলেছেন, প্রশ্নবিদ্ধ রপ্তানিকারকরা তাদের গ্রাহক নন। তারা অন্যান্য কোম্পানির রপ্তানি অনুমতিপত্রের (ইএক্সপি) বিপরীতে ঋণপত্র জারি করেছে যা এই কোম্পানিগুলোর নয়। এদিকে গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সিআইআইডি জানায়, রপ্তানির নামে ১০টির মতো আরএমজি কারখানা প্রায় ৩০০ কোটি টাকা পাচার করেছে। যা এই ৩৩টি প্রতিষ্ঠানের পাচার হওয়া ৮২১ কোটি টাকার মধ্যে অন্তভুক্ত।
কাস্টমস কর্মকর্তারা বলেছেন, অর্থ পাচারের জন্য প্রতারকরা এনবিআর সার্ভারে কোড-২০ ব্যবহার করে, যা প্রকৃত রপ্তানির আগে আমদানিকারকদের কাছে ‘নমুনা’ প্রেরণকে নির্দেশ করে। এ ক্ষেত্রে রপ্তানি আয়ের প্রশ্নই আসে না। অর্থ পাচারের আরেকটি জনপ্রিয় উপায় হলো আন্ডার ইনভয়েসিং বা প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কম মূল্য দেখানো বা পণ্যের পরিমাণ কম দেখানো। এই ৩৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৯টি প্রতিষ্ঠানই এ উপায় অবলম্বন করেছে।
উদাহরণস্বরূপ, ৪টি কোম্পানি— এশিয়া ট্রেডিং করপোরেশন, সাবিহা সাইকি ফ্যাশন, ইমু ট্রেডিং করপোরেশন এবং ইলহাম—জানুয়ারি ২০২০ থেকে ডিসেম্বর ২০২২ সালের মধ্যে কমপক্ষে ১ হাজার ৭৮০টি চালান পাঠানোর জন্য কোড ২০ ব্যবহার করেছে। যদিও সাধারণত নমুনা পণ্য ১০ কেজি থেকে ১০০ কেজি পর্যন্ত হয়। এই চালানের প্রতিটির ওজন ছিল ১০ হাজার কেজির বেশি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এনবিআর সার্ভার এবং কাস্টমস কর্মকর্তারা রপ্তানির সময় সঠিকভাবে তদারকি বা যাচাই-বাছাই না করাই এসব চালান কোন ধরনের বাধা ছাড়াই চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে যেতে পেরেছে।
আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বাকি ২৯ রপ্তানিকারক ৫৫৪ কোটি টাকার ১৪ হাজার ৮৭৮ টন গার্মেন্টস পণ্য পাঠালেও তারা রপ্তানি আয় দেখিয়েছে মাত্র ১১১ কোটি টাকা। এসব নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একটি টি-শার্টের গড় দাম দেখানো হয়েছে ১২ টাকা থেকে ২১ টাকা এবং এক জোড়া প্যান্টের দাম দেখানো হয়েছে ১৭ থেকে ৫৪ টাকা, যা প্রকৃত দামের চেয়ে ৪ থেকে ১০ গুণ কম।
ঘটনা সম্পর্কে এশিয়া ট্রেডিং করপোরেশনের পরিচালক (অপারেশন্স) মাহমুদ আলম, ইমু ট্রেডিং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল কাদের, ইলহামের মালিক নুরুল আমিন, সাবিহা সাইকি ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাকিল এবং হংকং ফ্যাশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান দাবি করেছেন জালিয়াতির সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। মাহমুদ আলম বলেন, আমার কোম্পানি ২০১৯ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে। আমি জানি না কারা এই পণ্যগুলো রপ্তানি করেছে।মিজানুর রহমানও অজ্ঞাত কয়েকজনকে দায়ী করে তাদের শাস্তি দাবি করেন।
এদিকে সিআইআইডির মহাপরিচালক মোহাম্মদ ফখরুল আলম বলেছেন, তদন্ত অব্যাহত থাকায় পাচারের পরিমাণ এবং জড়িত কোম্পানির সংখ্যা উভয়ই বাড়তে পারে।আমরা ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো (আইসিডি) এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে তথ্য সংগ্রহ করছি। সেইসঙ্গে আরও অন্তত ২৫টি প্রতিষ্ঠানের ১০ হাজারের বেশি চালানের যাচাই-বাছাই চলছে।