শফিক রহমান : এমডিদের পদত্যাগ নাটকীয়তা নিয়ে জোরালো আলোচনা চলছে ব্যাংক পাড়ায়। ব্যাংক এমডিদের সুরক্ষায় ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা থাকলেও তা যেনে থোরাই কেয়ার করছেন বেসরকারি ব্যাংক মালিকরা। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এনিয়ে জোরালো ভূমিকা নেননি রহস্যজনক কারণে।
কার স্বার্থে কোন ব্যাংক এমডি পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন তা নিয়ে চলছে আলোচনা। রহস্যর বিষয় হচ্ছে পদত্যাগে বাধ্য ব্যাংক মালিকদের কোনো বিচার হয়নি। ফলে বেসরকারি ব্যাংক মালিকরা আস্কারা পেয়ে যান। এমডি পদত্যাগ নাটকের শুরুটা ছিল ন্যাশনাল ব্যাংক এমডিকে নিয়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যাংক এমডিদের সুরক্ষায় ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করে বলেছিল, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কেউ স্বেচ্ছায় পদ ছাড়তে চাইলে এক মাস আগে পদত্যাগের কারণ জানিয়ে নিজ ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কারও চুক্তি বাতিল বা কাউকে পদত্যাগে বাধ্য করা যাবে না।
কিন্তু এই প্রজ্ঞাপন জারির পর ন্যাশনাল ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের এমডি পদত্যাগ করেন। এতে এই নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকও রহস্যজনক কারণে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি পরের এমডিকে দ্রুত অনুমোদন দিয়ে যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। ফলে এই নির্দেশনা প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
শেষমেষ পদত্যাগ ঘটনা বাড়তে থাকায় পদত্যাগ করা ব্যাংক ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এর অংশ হিসেবে আজ সোমবার সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক (এসবিএসি) হাবিবুর রহমান ও পদ্মা ব্যাংকের এমডি তারেক রিয়াজ খানের সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার ও ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো. নাছের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কক্ষে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ব্যাংক এশিয়া থেকে আরিফ বিল্লাহ আদিল চৌধুরীর এমডি পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর বিষয়ে জানতে কাল মঙ্গলবার ডাকা হয়েছে ব্যাংক এশিয়ার চেয়ারম্যান রোমো রউফ চৌধুরীকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, বর্তমান আর্থিক সংকটের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাইছে না, নতুন করে কোনো ব্যাংকে সংকট তৈরি হোক। এ ছাড়া ব্যাংকের এমডিরা যাতে পেশাদারিত্বের সঙ্গে ব্যাংক পরিচালনা করতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই চেষ্টার অংশ হিসেবে এর আগে ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করা এমডি মেহমুদ হোসেনকে কাজে ফিরিয়ে এনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নানা অনিয়মের কারণে দুই বছর ধরে ন্যাশনাল ব্যাংক নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ প্রদান নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আবার তুলেও নিয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকটি চট্টগ্রামের একটি গ্রুপের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা সুদ মওকুফ করেছে। এর ফলে ন্যাশনাল ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। মাঝেমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী নগদ জমা (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমার (এসএলআর) অর্থ রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ জন্য গুনছে জরিমানা।
এর মধ্যে মেহমুদ হোসেনকে ছাড়াই চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ব্যাংকটির পর্ষদ সভায় ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের ঋণ নবায়ন করা হয়। সেদিনই গ্রাহক ব্যাংক থেকে ২২ কোটি টাকা তুলে নেন। এরপর আরও কয়েকজন গ্রাহকের ঋণ প্রস্তাব পর্ষদে পাঠানোর জন্য এমডির ওপর সিকদার পরিবারের দুই সদস্য চাপ তৈরি করেন বলে জানা গেছে। তবে মেহমুদ হোসেন এতে রাজি ছিলেন না।
এমন পরিস্থিতিতে মেহমুদ হোসেনকে সিকদার পরিবারের বনানীর বাসায় ডেকে পাঠানো হয়। এ সময় রন হক সিকদার ও রিক হক সিকদার সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ওই সময় মেহমুদ হোসেনের মুঠোফোনে যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় বলে একটি সূত্র জানায়। এরপর দিন তিনি অফিস করেন। বুধবার সব বিভাগের প্রধানদের সঙ্গে সভা করেন। এরপর পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যান।
এমন ঘটনার প্রেক্ষাপটে গত সপ্তাহে নিজের পদ থেকে সরে দাঁড়ান পদ্মা ব্যাংকের এমডি তারেক রিয়াজ খান। এর আগে গত ২৬ জুলাই পদত্যাগ করেন ব্যাংক এশিয়ার এমডি আরিফ বিল্লাহ আদিল চৌধুরী। তাঁরা আর অফিস করছেন না। গত বৃহস্পতিবার এসবিএসি ব্যাংকের এমডি হাবিবুর রহমানও পদত্যাগপত্র জমা দেন। তবে তিনি রোববার থেকে আবার অফিসে যাচ্ছেন।
এই পরিস্থিতিতে পদত্যাগের কারণ জানতে পদ্মা ও এসবিএসি ব্যাংকের এমডিকে ডেকে পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। সূত্র জানায়, পদ্মা ব্যাংকের এমডি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বলেছেন যে স্ত্রী অসুস্থ থাকায় তাঁর পক্ষে ব্যাংককে সময় দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাংকের কোনো পরিচালক বা চেয়ারম্যানের চাপে তিনি পদত্যাগ করেননি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে তখন তাঁকে বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকৃত তথ্য দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। না হলে ব্যাংক খাত নিয়ে আমানতকারীদের ভেতর ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হতে পারে বলে জানানো হয়।
এদিকে এসবিএসি ব্যাংকের এমডি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, তিনি আনুষ্ঠানিক পদত্যাগ পত্র জমা দেননি এবং নিয়মিত অফিস করছেন। এ সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত তাঁর পদত্যাগসংক্রান্ত সংবাদ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কোনো জবাব দেননি বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে।
ব্যাংক এশিয়ার এমডি আরিফ বিল্লাহ আদিল চৌধুরী কেন পদত্যাগ করেছেন, তা জানতে ব্যাংকের চেয়ারম্যান রোমো রউফ চৌধুরীকেও ডেকেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তিনি দেশে ফিরে আগামীকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে দেখা করবেন বলে জানা গেছে।এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকর মুখপাত্র মেজবাউল হক জানান, পদ ছেড়ে দেওয়া এমডিদের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত নন।
পরিচালকদের চাপে ব্যাংক এমডিদের পদত্যাগ ঠেকাতে ২০১৪ সালে একটি সুরক্ষা নীতিমালা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এই নীতিমালা দৃশ্যত খুব একটা কাজে আসেনি। ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মালিকানায় আসার সময় তৎকালীন এমডিদের বাদ দেয় এস আলম গ্রুপ। তখন নতুন এমডি হিসেবে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের ব্যাপারে তড়িঘড়ি করে অনুমোদনও দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, আগে পরিস্থিতির বিবেচনায় অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এখন আমরা চাই না নির্দোষ কোনো এমডি পদ ছেড়ে চলে যাক। কারণ, এই মুহূর্তে ব্যাংক খাত নিয়ে এমনিতেই নানা ধরনের আস্থাহীনতা কাজ করছে।
এদিকে এসবিএসি ব্যাংকের এমডির পদত্যাগসম্পর্কিত খবরের প্রতিবাদে ব্যাংকটি বলেছে, এমডি হাবিবুর রহমানের পদত্যাগসংক্রান্ত তথ্য ঠিক নয়। তিনি নিয়মিত অফিস করছেন।
এমন পরিস্থিতিতে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সম্প্রতি ব্যাংক এমডিদের সঙ্গে এক সভায় বলেছেন কোনো অনিয়মের চাপ এলে তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে। বাংলাদেশ ব্যাংক এমডিদের সুরক্ষা দেবে। এরপরও যাতে অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করা না হয়।
এর জের ধরেই পদত্যাগ করা এমডিদের নিয়ে বসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ব্যাংক এমডিরা এতে ভরসা করতে পারছেন না। কারণ, কয়েকটি ব্যাংকের মালিকপক্ষের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যত জিম্মি। এসব ব্যাংকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।