লিড নিউজ

নব আনন্দে ১লা বৈশাখ

 

 

ঢাবি প্রতিনিধি : করোনা মহামারির কারণে গত দু’বছর পালিত হয়নি বাঙ্গালীর প্রাণের পহেলা বৈশাখ উৎসব। করোনার কারণে জীবনের গতি ও ছন্দ বদলে যায়। সেলক্ষে সবকিছু ‘নির্মল’ করার প্রত্যয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সড়ক দ্বীপ থেকে বের হয়েছে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা।
ওদিকে মহামারির দুঃসময় অতিক্রম করে মানুষের জীবনে স্বাভাবিক কর্মপ্রবাহ ফিরে আসার নতুন বাস্তবতাকে তুলে ধরতে আনন্দের গান দিয়ে সাজানো হয় এবারের ছায়ানটের গানের অনুষ্ঠান। মূল ভাব ছিল ‘নব আনন্দে জাগো’।সকাল ৬টা ১৫ মিনিটে রামকেলি রাগ পরিবেশনার মধ্য দিয়ে রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠান শুরু হয়।

ছায়ানট সভাপতি সনজীদা খাতুন নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য দেন। নব্বই বছরে পা রাখা সনজীদা খাতুন শারীরিক দুর্বলতার কারণে অনুষ্ঠানে সরাসরি উপস্থিত হতে পারেননি। তিনি ভার্চুয়ালি বক্তব্য রাখেন। পরে তার গাওয়া ‘নব আনন্দে জাগো’ গানটি বাজিয়ে শোনানো হয়। নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি সারওয়ার আলী। প্রায় আড়াই ঘণ্টার অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন এই পাঁচ কবির গানের সঙ্গে ছিল লালন সাঁই, গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারীর গান, গিরীন চক্রবর্তীর পল্লীগীতি ও নুরুল ইসলাম জাদিদের ভাওয়াইয়া। সঙ্গে ছিল আবৃত্তি পাঠ।

এদিকে এবারই প্রথম ঢাবির চারুকলা অনুষদের বদলে টিএসসি থেকে শোভাযাত্রা বের করা হলো। যা ঢাবির উপাচার্যের বাসভবন এলাকা ঘুরে আবারো টিএসসিতে এসে শেষ হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রায় উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি মন্ত্রী কে এম খালিদ, ঢাবি উপাচার্য মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান, উপ-উপাচার্য মুহাম্মদ সামাদ, চারুকলা অনুষদের ডীনসহ অন্যরা।
আয়োজকরা জানান, মেট্রোরেলের কাজ চলায় শাহবাগ থেকে টিএসসি পর্যন্ত সড়ক সঙ্কুচিত হয়ে পড়ায় এবার শোভাযাত্রার গতিপথে পরিবর্তন আনা হয়। যদিও এই পরিবর্তনে স্বাভাবিক স্বতস্ফূর্ততায় তেমন কোনো ছন্দপতন হয়নি। বরং হাজারো মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হলো পুরো প্রাঙ্গন। আর এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকেই মহামারির গ্লানি ভুলে সুসময়ের বার্তা দিলো চারুকলা শিক্ষার্থীদের গড়া রং-বেরঙের মাছ, পাখি, ঘোড়া, টেঁপা পুতুলসহ রাজা-রানী মোটিফের মধ্য দিয়ে।

বৃহস্পতিবার (১৪ এপ্রিল) সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে থেকে বের হয় শোভাযাত্রাটি। ‘নির্মল করো, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’ প্রতিপাদ্যে বের হওয়া শোভাযাত্রার গন্তব্য ছিল ঢাবি ভিসির বাসভবন। ভিসির বাসভবনের সামনে স্মৃতি চিরন্তন ঘুরে শোভাযাত্রাটি আবার টিএসসিতে ফিরে যায়। আয়োজকরা জানান, মেট্রোরেলের কাজ চলায় শাহবাগ থেকে টিএসসি পর্যন্ত সড়ক সঙ্কুচিত হয়ে পড়ায় এবার শোভাযাত্রার গতিপথে পরিবর্তন আনা হয়।

শোভাযাত্রা ঘিরে ছিল কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুরো শোভাযাত্রার চতুর্দিকে সোয়াট, ডিবি, র‍্যাব, পুলিশ ও স্কাউট সদস্যদের কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী ছিল চোখে পড়ার মতোই। এছাড়াও সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম, শিক্ষক-কর্মকর্তাদের টিমও তৎপর ছিল।

শোভাযাত্রার পুরো পথে সিসিটিভি ক্যামেরা ও পর্যাপ্তসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল। পথে কেউ মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে পারেননি। কারণ চতুর্দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে মানবপ্রাচীর গঠন করা হয়। নিরাপত্তার জন্য রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকায় কেন্দ্রীয় রাস্তা বন্ধ করে রাখা হয়।

এদিকে বাংলা নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে দেশের সব জেলা ও উপজেলায় বৈশাখী র‌্যালি আয়োজনের খবর পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির দুইদিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা আজ শুরু হয়েছে। বাংলা একাডেমি এবং বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এবং বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন তাদের নিজেদের প্রাঙ্গণে নববর্ষ মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে।

সব সরকারি-বেসরকারি টিভি, বাংলাদেশ বেতার, এফএম ও কমিউনিটি রেডিও বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করে এবং বাংলা নববর্ষের ওপর বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করেছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার ও বেসরকারি চ্যানেলসমূহ রমনা বটমূলে ছায়ানট আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করে।

অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাদের পুরোনো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এ উপলক্ষে তারা নতুন-পুরাতন খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন।

মূলত ১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ‘ফসলি সন’ নামে, পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষে পয়লা বৈশাখ বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে। এ সময় ঢাকায় ছায়ানটের উদ্যোগে সীমিত আকারে বর্ষবরণ শুরু হয়। স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে এই উৎসব নাগরিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে।

সংশ্লিষ্ট খবর

Leave a Reply

Back to top button