চিকিৎসায় চলছে অপচিকিৎসা, প্রতিকারের দায় কার
ফজলে রাব্বী সোহেল : আদিম কাল থেকেই মানুষ তাদের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন প্রকার পদ্ধতির অবলম্বন করে আসছে। প্রাকৃতিক গাছ-গাছালি, লতাপাতা, ঝারফুক, তাবিজ-কবজের চিকিৎসা থেকে শুরু করে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা তাদের নিরলশ গবেষনার মাধ্যমে আজকের এই চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নয়ন সাধন করেছেন। ফলে চিকিৎসা বিজ্ঞান হয়েছে আধুনিক এবং যুগোপযোগী। তারপরও বিজ্ঞানীরা থেমে থাকেননি, প্রতিদিনই তারা তাদের গবেষনা কর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। এত কিছুর পরও কিছু অসাধু চিকিৎসক ও নকল ওষুধ ব্যবসায়ীদের কারণে রোগীর মৃত্যুর খবরে আমাদের হতাশ হতে হয়।
জীবন রক্ষাকারী ওষুধ জীবন হরণের উপাদানে পরিনত হওয়ার খবরও বিভিন্ন সময় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে থাকে। আবার বহু খবরতো অজানাই (অ-প্রকাশিত) থেকে যায়। চিকিৎসার উপকরণ নিয়ে এমন সব ঘটনায় মানুষের মনে ভিতি তৈরী হয় এবং উদ্যোগ (চিন্তার) সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষের জীবনে কখনো কোন কারণে অসুস্থ হয়ে পরলে সুস্থতার জন্য চিকিৎসকের সরনাপন্য হতে হয় এবং চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধও সেবন করার প্রয়োজন হয়। জীবন রক্ষাকারী এসব ওষুধ নকল ও নি¤œমানের হওয়ার কারণে অনেক সময় মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ১৯৮০ থেকে’ ৯২ সাল পর্যন্ত ক্ষতিকর প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে কয়েক হাজার শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর প্যারাসিটামল সংশ্লিষ্টতায় ২ হাজার শিশু মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করে জানায়, ভয়াবহ ওই ঘটনায় অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে পাঁচটি মামলা করা হয়েছিলো। ভেজাল ওষুধ কেন্দ্রিক ভয়াবহতায় শিশু হত্যাযজ্ঞের মামলাগুলো চলছে ২৬ বছর ধরে। অতিসম্প্রতি একটি মামলায় আদালত দোষী ব্যক্তিদের এক বছর করে কারাদেশ দেয়। বাকি চারটি মামলা এখনো নিস্পত্তিহীন। বিচারের এ দীর্ঘসূত্রতা ও শাস্তির এমন বিধানে নকল ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকারী চক্রগুলো আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। দেশে চার ক্যাটাগরিতে ৫৫১টি প্রতিষ্ঠান বা তারও কিছু বেশী প্রতিষ্ঠান নানা রকম ওষুধ প্রস্তুত করে। এর মধ্যে ২৬৮টি ইউনানি, ২০১টি আয়ুর্বেদী ও হারবাল এবং ৮২টি হোমিও ক্যাটাগরির ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দেশের বৈধ ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান গুলোকে নিয়মনীতি অনুযায়ী ঢাকা টেস্টিং ল্যাবরেটরী থেকে ওষুধের মান পরীক্ষা করা সহ অন্যান্য উপাদানের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু নমুনা ওষুধে এসব নিয়মনীতি হুবহু পালন করা হলেও বাজারে দেওয়া ওষুধে তার কোন মিল নেই বলে জানাগেছে। অনুমোদিত সার্টিফিকেট অনুসারে ওষুধ প্রস্তুত হচ্ছে কিনা সে বিষয়টি তদারকি করার কেউ আছে কিনা তা আর আমাদের জানা থাকছে না।
সম্প্রতি দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি সংবাদপত্র তাদের এক রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশী ওষুধের সুনাম থাকলেও দেশজুড়ে ওষুধ বাণিজ্যে সীমাহীন নৈরাজ্য চলছে। নকল, ভেজাল ও নি¤œমানের ওষুধের ছড়াছড়িতে মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। দেশের সর্বত্রই নকল, ভেজাল ও নি¤œমানের ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন কোনভাবেই নিয়ন্ত্রন করা যাচ্ছে না। সারা দেশে ওষুধ বাণিজ্যের এই অরাজক পরিস্তিতির জন্য কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র মুখ্য ভ‚মিকা রাখছে। কঠোর মনিটরিং ও কার্যকর শাস্তির ব্যবস্থা না থাকায় ভেজালকারীরা বেপরোয়া। যেসব কোম্পানি নকল ও ভেজাল ওষুধ তৈরীর দায়ে অভিযুক্ত, সেগুলোই ঘুরে ফিরে বার বার এ তৎপরতায় লিপ্ত থাকছে। ভেজাল ও নকল ওষুধের কারণে অনেক সময় রোগী সুস্থ হওয়ার বদলে হয়ে পড়ছে আরও অসুস্থ। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। কিন্তু ওইসব ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিরা পার পেয়ে যাচ্ছেন আইনের ফাঁকে। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হোতারা থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। নকল ওষুধ প্রস্তুত ও ভেজাল ওষুধ বিপণনে রাজধানীর মিটফোর্ডকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট, ফার্মেসি গুলোর সংগঠন বাংলাদেশ কেমিস্ট এÐ ড্রাগিস্ট সমিতির কোনো কোনো নেতা গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখছেন। সরকারের মাঠ পর্যায়ে থাকা ড্রাগ সুপারদের যোগসাজশে দেশজুড়ে সংঘবদ্ধ ভাবে গড়ে উঠেছে নকল, ভেজাল ওষুধের বিশাল নেটওয়ার্ক। ওষুধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে এই অপরাধীদের তৎপরতা কমে আসবে। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতায় কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রন করা যাচ্ছেনা ভেজাল, মানহীন ও নকল ওষুধ। শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল সবখানেই ভেজাল ওষুধের বাধাহীন দৌরাত্ম্য। জীবন বাঁচানোর ওষুধ কখনো কখনো হয়ে উঠছে প্রাণঘাতী। ওষুধ সম্প্রর্কিত জনসচেতনতামূলক প্রচারে নানা বাধাবিপত্তি থাকায় ক্রেতারা জানতেও পারছেন না তারা টাকা দিয়ে কি ওষুধ কিনছেন। ওষুধ বাণিজ্যের নৈরাজ্য রোধে ক্রেতাদের রক্ষায় কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই।
এই যদি হয় জীবন রক্ষাকারী ওষুধের অবস্থা তা’হলে এদেশের মানুষ কোথায় যাবে। কারকাছে এই সমস্যার সমাধান পাবে। এটা খুবই দুঃখজনক। তারপরও কি ওষুধ প্রশাসন, স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় বা সরকারের টনক নড়বে?
এদিকে হারবাল ও ইউনানি কেন্দ্রীক অর্ধশতাধিক ভূঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠানের সংঘবদ্ধ চক্র যেনতেন ভাবে তৈরী করা ওষুধ গ্রামগঞ্জে একচেটিয়া বাজারজাত করছে। অর্ধশিক্ষিত অসচেতন মানুষকে টার্গেট করেই প্রতিষ্ঠনগুলো নানা ট্যাবলেট-সিরাপের বিরুপ প্রতিক্রিয়ায় গড়ে প্রতি বছর তিন শতাধিক ব্যাক্তির জীবনহানি ঘটছে। যা টাকার মূল্যে দেশে মোট উৎপাদিত ওষুধের অন্তত ২ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি বছর ৪ শতাধিক কোটি টাকা মূল্যের ভেজাল, নকল ও নি¤œমানের ওষুধ তৈরী হয়। এসব ওষুধে যেমন রোগ সারছে না। অপর দিকে কিছু চিকিৎসক ও বেসরকারী হাসপাতাল রোগীদের নিয়ে গলাকাটা বাণিজ্য করছে। মানুষের রোগ হলে যখন সে সবচেয়ে বেশী অসহায় বোধ করে, তখনই এই অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে অতি মুনাফালোভী হাসপাতালের মালিক, চিকিৎসক ও ওষুধ কোম্পানীগুলো অন্যায্য ব্যবসা শুরু করে। একজন মানুষ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেলে তাকে সুচিকিৎসা পাওয়ার বদলে জিম্মি হতে হয় তাদের কাছে। রাজধানী সহ সারাদেশে বেসরকারী ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিতে চিকিৎসার নামে চলে গলাকাটা বাণিজ্য। সরকারী স্বাস্থ্য নীতির তোয়াক্কা না করে এসব প্রতিষ্ঠান চিকিৎসার নামে রোগীদের জীবন বিপন্ন করে তোলে। এসব বিভিন্ন কারণে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি দিন দিন মানুষের আস্থা একবারে তলানিতে নেমে এসেছে। হাসপাতাল গুলোর অব্যবস্থাপনা, অপচিকিৎসা, চিকিৎসকদের খারাপ আচরণ এবং ওষুদের ওপর আস্থা কমে যাওয়ায় দেশের মানুষ চিকিৎসা নিতে বিদেশমুখী হচ্ছেন। এক পরিসয়খ্যানে দেখাগেছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ৫ থেকে ৬ লাখ মানুষ চিকিৎসা নিতে বিদেশে যান। এর মধ্যে কেবল ভারতেই যান প্রায় ৩ লাখ মানুষ।
সমাজে চিকিৎসকদের পেশাকে একটি মহাৎ পেশা হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। কিন্তু কিছু কিছু চিকিৎসকের অসাদাচরণ ও অপেশাদারিত্বের কারণে এই পেশাকে তারা কলংকিত করছেন। আবার নকল সনদধারী ভুয়া চিকিৎসকও নামের পাশে বড় বড় ডিগ্রীর নাম বসিয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে বিভিন্ন ক্লিনিক ও চেম্বারে চিকিসা দিচ্ছে। ঐ সমস্ত চিকিৎসকেরা রোগীর চিকিৎসাপত্রে অপ্রয়োজনীয় অনেক ওষুধ লিখছেন হরহামেশা। অনেক সময় আবার রোগের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই এমন ওষুধও ব্যবস্থাপত্রে লিখছেন। এমনকি সামান্য জ¦র, ঠান্ডা ও কাঁশির জন্যও ডজন ডজন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা লিখে দেয়। প্রয়োজন না থাকলেও হাসপাতালে (ক্লিনিক) ভর্তি পর্যন্ত করিয়ে ছাড়ছেন ডাক্তাররা। সুযোগ থাকলে অপারেশনের মুখোমুখি করিয়ে লাইফ সাপোর্ট পর্যায়ে পৌছে দেয়া হয় রোগীকে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ডাক্তারের জন্য রয়েছে লোভনীয় কমিশন। সরকারী বা বেসরকারী হাসপাতাল থেকে রোগী বাগিয়ে নিয়ে অভিজাত হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারলেই শতকরা ৫০ ভাগ বা তারও বেশী “ভর্তি ফি” সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের পকেটে যায়। এসব কমিশন বাণিজ্যের প্রভাবে চিকিৎসা ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যায়। এতে করে গরিব মানুষ চিকিৎসা নিতে গিয়ে আরও নিঃস্ব হয়ে পড়ে। সাধারণ চিকিৎসা থেকে শুরু করে অপারেশন, ক্যান্সার রোগীদের কেমোথেরাপি, অর্থোপেডিক রোগীদের ফিজিওথেরাপি ও কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিসের ক্ষেত্রেও আলাদা কমিশন নির্ধারণ করা আছে। এমনকি ওষুধ লেখার জন্য আগে থেকেই ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে কমিশনের নামে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা নিয়ে থাকেন বহু চিকিৎসক।
এদিকে চিকিৎসকেরা তাদের ব্যবস্থাপত্রে রোগীর রোগ দ্রæততম সময়ের মধ্যে সারানোর জন্য যন্ত্রতন্ত্র এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার করার বিষয়টি নিয়ে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের বেশ ভাবিয়ে তুলছে। এমন নকল ওষুধ ও এন্টিবায়োটিকের অযথা ব্যবহারের কারণে এন্টিবায়োটিকও অনেক ক্ষেত্রে রোগ সারাতে পারছে না। এ ব্যাপারে বিবিসি বাংলা ঢাকার সাংবাদিক সানজানা চৌধুরী তার এক প্রতিবেদনে এন্টিবায়োটিকের বিরুপ প্রতিক্রিয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের শিশুদের জন্য “অশনি সংকেত” এন্টিবায়োটিক দিয়ে রোগ সারছেনা। তিনি তার রিপোর্টে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মিসেস তাসমিন নাহার মিথুনের আট বছরের মেয়ের একটি উদাহরণও তার রিপোর্টে উল্লেখ করেন।
ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ও ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ডাঃ লোটে শেরিং ২০১৯ সালে বাংলাদেশে এসে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে বলে ছিলেন, “ভালো চিকিৎসক হতে হলে আগে হতে হবে ভালো মানুষ”। আসলে অতীব সত্য কথার একটি হলো চিকিৎসা ক্ষেত্রের মতো এমন মহান পেশায় ভাল মানুষের খুবই প্রয়োজন। আবার আশার কথা হচ্ছে, দেশের সব চিকিৎসকই খারাপ না। তার মধ্যে অনেক ভালো, দয়ালু ও সৎ মানুসিকতার চিকিৎসকও আছেন এ দেশে।
সর্বোপরি বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র দেশকে সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে একটি টেকসই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার (গঠন) উন্নয়ন করা খুবই প্রয়োজন। লেখক: সহ-সভাপতি, সোনারগাঁ প্রেস ক্লাব।